এক নজরে

ফিরে দেখা, মারাদোনাকে ঘিরে সেই আবেগ-উন্মাদনা

By admin

November 26, 2020

‘সকলেই ফুটবল খেলে, স্রেফ একজন হয় বস’। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে কার্যত কলকাতার থিম সঙ্ হয়ে উঠেছিল এই গানটাই। কার উদ্দেশ্যে গান, তা আজ আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তিনটে দিনের সফর, যেন ওলোট পালোট করে দিয়ে গিয়েছিল কলকাতার আবহাওয়াকে। এটাই মারাদোনা। ২০০৮ এর আগে এই মাপের ফুটবলার আর ভারতে আসেন নি। এশিয়াতেও সেবারই প্রথম পা রাখা তাঁর। তাই প্রথমবারের আকর্ষন বরাবারই আবেগ বেশী থাকে। মারাদোনাকে নিয়েও একই চিত্র দেখা গিয়েছিল।

এমনিতেই কলকাতা বরাবরই আবেগ প্রবন সব কিছুতেই। বিশেষ করে শিল্প, সাহিত্য, ক্রীড়া বিষয় হলে তো কথাই নেই। কিছুদিন আগে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পর এনডিটিভির রাভিশ কুমার একটি বিশেষ প্রতিবেদনে স্বীকার করে নিয়েছিলেন যে, কিছু ক্ষেত্রে কেন বাংলা সংবাদমাধ্যম সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমের থেকে অনেক আলাদা। তারা শিল্পবোধকে বিশ্লেষন করতে পারে। মারাদোনার ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে বৈকি। ২০০৮ সেই কলকাতা সফরের সফরসঙ্গী ছিল এই কলমচি।

প্ৰথমবারের কলকাতা পা রাখার ঐতিহাসিক মুহূর্তটাও যেন প্রতিযোগিতা ছিল কলকাতার সংবাদমাধ্যমের কাছে। এক বাংলা দৈনিকের সম্পাদক তো আবার তাদের চিত্র সাংবাদিককে টিকিট কেটে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন ফ্রাঙ্কফুর্টে। কারন মারাদোনারা কলকাতায় আসার সময় এখান থেকেই কানেকট্টিং ফ্লাইট ধরেছিলেন। শুধু তাই নয়, মারাদোনার ঠিক পিছনে বসার সিটটিকে সংশ্লিষ্ট চিত্র গ্রাহকে বুক করে দেওয়া হয়েছিল, সেই দৈনিকের পক্ষ থেকে। মানে শহর কলকাতায় মারাদোনা পা রাখার আগেই কানেক্টিং ফ্লাইটের মধ্যে একটা ছবি করিয়ে নেওয়া। সবার আগে যাতে এক্সক্লুসিভ ছবি পাওয়া যায়। সংশ্লিষ্ট চিত্র সাংবাদিক আবার মারাদোনার হাতে সেই দৈনিকের একটি ডেমো ধরিয়ে দিয়ে ফ্লাইটের মধ্যেই ছবি করেছিল যে মারাদোনা বাংলা দৈনিক পড়ছেন।

কলকাতায় যখন বান্ধবী ক্লদিয়াকে সঙ্গে নিয়ে তিনি নেমেছিলেন তার আগেই সেই চিত্র সাংবাদিক এক্সক্লুসিভ ছবি করে ফেলেছিল মারাদোনার। এমন নজিরও আছে এই কলকাতাতেই। মারাদোনাকে নিয়ে এমন হয়। আমি একাধিক ব্রাজিল সাপোর্টারকে দেখেছি যারা বিশ্বকাপে ব্রাজিলকে সমর্থন করলেও মারাদোনাকে উপেক্ষা করতে পারেন না। এই ঘটনা তো এই প্রথম নয়, বিখ্যাত বাঙালী চিত্রগ্রাহক অমিয় তরফদারের সেই ঐতিহাসিক নামাবলী পরিয়ে মারাদোনার ছবিও তো বাঙালী ক্রীড়াপ্রেমীদের কাছে এক ঐতিহাসিক দলিল। আমাকে এই ছবিটি দেখিয়েছিলেন আরেক প্রখ্যাত সাংবাদিক জিসি দাস। তার কাছে এখনও রয়েছে এই ছবি। আর অমিয় তরফদারের পরিবারের কাছে রয়েছে অবশ্যই।

ফুটবলের রাজপুত্র। বৈভবে, আচারে সবার থেকে আলাদা হবেন সে আর অন্যকথা কি। তবে এই আলাদা, সত্যি অন্যদের থেকে শত-হাজারগুন আলাদা। যে মানুষটিকে দেখেছিলাম, সেটি একটি আদ্যপান্ত আবেগপ্রবন মানুষ। যার অহংকার খুঁজে পাওয়া মুস্কিল। কলকাতার জনসমুদ্র তাকে আবেগতাড়িত করে তুলেছিল আরও। বারবার বুকে টোকা মারছিলেন। যেন বলতে চাইছিলেন তোমাদের হৃদয় এই বুকে। সিএমজি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী প্রথমবার কলকাতা এসেছিলেন তিনি। সুতরাং তিনি বেশ কিছু জায়গা য় যেতে দায়বদ্ধ ছিলেন। কিন্তু ফুটবল মাঠ আর মনের মানুষ পেলে বাঁধা সময়ের থেকেও বেশী সময় কাটিয়ে দিয়েছেন অবলীলাক্রমে। ছুটে গিয়েছিলেন জ্যোতিবসুর মতন প্রবীন রাজনীতিবিদের বাড়িতেও।

পায়ের ছাপ দিয়ে গিয়েছিলেন। কথা ছিল ফুটবল স্কুল হবে কলকাতায়। তিনি সেই স্কুলের উদ্বোধনও করে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেইগুলো বোধহয় হাওয়ায় ভেসে বেড়ানো এক গল্প ছিল। মহেশতলাতে গিয়ে শিলান্যাস করা তার ফলক কোথায় হারিয়ে গিয়েছে কেউ জানে না। আর সেই প্রতিশ্রুতিও হারিয়ে গিয়েছে ফলকের মতনই। তবে কলকাতার মনে আছে আজও সেই উন্মাদনা। মারাদোনাকে এক পলক চোখের দেখার আকুতি। আজ বাঙালী সেগুলোই যেন রোমন্থন করবে। বুয়েনর্স এয়ার্স থেকে এত দূরে থেকেও তাই চোখ ছলছল বাঙলার ক্রীড়া প্রেমীদের।