এক নজরে

প্রেম বিদ্রোহ স্বাধীনতার দিব্যি

By admin

September 07, 2023

ঘন অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে তীব্রবেগে ট্রেন ছুটছে। দেরাদুনগামী সেই ট্রেনে বসে তিনি ক্রমেই ভয়ানক বিষণ্ণতায় আচ্ছন্নন হয়ে পড়ছেন। তাঁর মন ছটফট করছে ফেলে আসা মাতৃভূমির জন্য। তাঁর গায়ে লাহোর থেকে নিয়ে আসা একটিমাত্র লাল শাল। সেটি তিনি দু’টুকরো করে ফেললেন, জড়িয়ে দিলেন তাঁর দুই ছেলেমেয়ের গায়ে। কিছুদিন আগে তাঁর মাতৃভূমিকেও কারা যেন ওই লাল শালটির মতোই দু’টুকরো করে দিয়েছে। তিনি আজ ছিন্নমূল। লাহোর থেকে দিল্লি এসেছিলেন, কিছুদিনের জন্য দেরাদুনবাসী হন। কাজ আর বাসস্থানের খোঁজে দিল্লি এসেছিলেন, ফেরার পথে দেরাদুনগামী ট্রেনে উঠে বসেছেন। সেদিন বিষন্ন আর বিপন্নতার তীব্র বেদনায় তাঁর মনে পড়ে হীর রঞ্ঝা প্রেমগাথার প্রণেতা সুফি কবি ওয়ারিশ শাহ-এর কথা। তাঁর উদ্দেশ্যেই লিখলেন দীর্ঘ কবিতা ‘আজি আখান ওয়ারিশ শাহ নু’ বা ‘An Ode to Warish Shah’

কিন্তু প্রগতিশীল লেখকদের সংস্পর্ষে, সমাজকল্যাণমূলক জড়িয়ে, রাজনৈতিক অস্থিরতায় সাধারণ মানুষের দুর্গতি ও তাদের অধিকার নিয়ে যখন আওয়াজ তুললেন, তখন তাঁর কলমে এল অন্য জোয়ার। কাব্যগ্রন্থ ‘লোক পীড়’ বা গণরোষ-এ তিনি ’৪৩-এর বাংলার দুর্ভিক্ষ ও যুদ্ধবিদ্ধস্ত অর্থনীতির তীব্র সমালোচনা করলেন। ক্রমে তাঁর কবিতা হয়ে উঠলো প্রতিবাদের অস্ত্র। ধীরে ধীরে তিনি এমনই এক কবিতে পরিণত হলেন, যে কোনো ভয়-ভীতি বা ফলাফলের তোয়াক্কা না করে অসঙ্গতির বুকে পদাঘাত করে। জীবন পথের নতুন অভিজ্ঞতায় প্রভাবিত চিন্তা-চেতনায় তাঁর কবিতার ভাষা গেল বদলে।

এরপর দেশভাগ। নিজের চোখেই দেখলেন মানবতার সেই বিশাল বিপর্যয়। রাজনৈতিক বিভীষিকার কবলে পড়ে একক রাষ্ট্রভুক্ত মানুষগুলি ধর্ম আর জাতের নামে আলাদা বাসস্থান খুঁজতে বাধ্য হলো। যুগ যুগ ধরে এক আকাশের নিচে বাস করা মানুষগুলি একে অপরের সঙ্গে ঘৃণা আর বিদ্বেষে জড়িয়ে পড়ল। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় হিন্দু, মুসলিম, শিখ মিলিয়ে ১০ লাখের বেশি মানুষ মরলো। তিনি নিজেও সেই দাঙ্গায় মরতে মরতে বাঁচলেও ভিতরে ভিতরে চুরমার হয়ে গেলেন। পাঞ্জাবী শরণার্থী হয়ে লাহোর থেকে দিল্লীতে এসেছিলেন অমৃতা প্রিতম। নতুন লড়াইয়ের জীবনে,  পারিপার্শ্বিক প্রভাবে অন্তর্জগতে জাগা তুমুল আলোড়নে, ১৯৪৮-এর সুগভীর মর্মযাতনায় মৃত্যু আর ঘৃণার রাজ্যে পুনরায় প্রেম আর জীবনের একটা নতুন অধ্যায় লিখতে আহবান জানিয়েছিলেন কবরে শায়িত ওয়ারিস শাহকে। তারপর দেশভাগে পাঞ্জাবের মেয়েদের দুর্দশা ফুটিয়ে তুললেন উপন্যাস ‘পিঞ্জর’-এ। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের পাশাপাশি সামাজিক অসঙ্গতির প্রতিরূপ বিশেষ করে পরিবারের হাতে অসহায় ও গুরুত্বহীন দুর্বিষহ নারী জীবন।গন্তব্যে পৌঁছনো যে কোনও নারীর আত্মাই তার নিজের অন্তরাত্মা। এ কথাটি শুধু ‘পিঞ্জর’-এর প্রধান চরিত্র পুরুর নয়, অজস্র গন্তব্যে পৌঁছোতে পারা এবং না-পারা নারীর অন্তরের কথা। অমৃতার নিজেরও।

আজন্ম ভালবাসার সন্ধানী অমৃতা তাঁর লেখায় বারেবারে প্রেম, সম্পর্ক, স্বাধীনতা, মুক্তির সংজ্ঞাকে ভেঙেচুরে এমন এক নতুন রূপ দিয়েছেন, যা ছিল তাঁর সময়ের থেকে অনেক এগিয়ে। তিনি বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানটির অকুণ্ঠ সমালোচনা করেছেন এবং নিজে এক দীর্ঘ জীবন বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ না থেকেও কাটিয়ে গেছেন শিল্পী ইমরোজের সঙ্গে। তবে অমৃতার প্রেম নিয়ে সব থেকে আলোচিত নাম সাহির লুধিআনভি। সাহিরের মতাদর্শ, সৌন্দর্য, শব্দশৈলী সবকিছুই বিবাহিতা ও এক সন্তানের জননী অমৃতাকে তীব্র বাসনায় জড়িয়েছিল। কিন্তু কোনো এক কারণে সাহির চাননি তাদের নৈকট্য। হয়তো তার আবেগের গভীরতা অমৃতার মতো অতল ছিল না। দূর থেকে চিঠির আদান-প্রদান, সেই অদৃশ্য স্পর্শ, সেই ছুঁতে পারা শব্দগুলোই তার কাছে বেশি আকর্ষণীয় ছিল। যে দুয়েকবার তারা গোপনে সাক্ষাৎ করেছেন, তাতে মুখরতার চেয়ে নৈঃশব্দ্যই বেশি ছিল। অমৃতা আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘রশিদী টিকেট’-এ কোনো রাখঢাক ছাড়াই সাহিরের সাথে তার সম্পর্কের কথা উল্লেখ করেছেন।

অমৃতা তাঁর সময়ের অন্য সব মেয়েদের মতো দুর্বিনীত নিয়তি পরিগ্রহ না করে সারাটা জীবন নিজের ইচ্ছেনুযায়ীই বেঁচেছেন। সামাজিক বন্ধন পুরোপুরি ছিন্ন করতে পারেননি ঠিকই তবে নিজের যাপিত জীবন দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন- এভাবেও বাঁচা যায়, এভাবেও একজন নারী বাঁচতে পারে। তিনি ভালোবেসেছেন, বিদ্রোহ করেছেন, পুরুষের প্রেমে মগ্ন হয়েছেন, আবার পুরুষের পরিসীমাটিও সচেতনভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন। তার জীবনদর্শন ও হৃদয়ের গূঢ়তম কথাগুলো নিঃসৃত হয়েছে তার সাহিত্যে, তার কবিতার ছন্দে, ঝংকারে। এক প্রাচীন অসঙ্গতির সমাজে প্রগতির বাহক হয়ে এসেছিলেন অমৃতা। সময়ের প্রয়োজনেই তিনি সাহিত্যে নারীবাদ ধারণ করেছিলেন।

অমৃতা তাঁর কবিতায়, গল্পে অকপটে নারীর মানসিক ও শারীরিক চাহিদা নিয়ে কথা বলেছেন। তাঁর অনেক কবিতায় নারী-পুরুষের শারীরিক চাহিদা সামাজিক বাঁধন থেকে ছিটকে বেরিয়ে এসে পবিত্র অপবিত্রতার সীমা অতিক্রম করে। প্রথম উপন্যাস ‘ডঃ দেব’ও একটি বিতর্কিত বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তোলে। সামাজিক বন্ধনের সঙ্গে অমৃতার এই নিরন্তর যুদ্ধ তাঁর লেখাকে পৌঁছে দেয় এক অন্য মাত্রায়। অমৃতা দেখিয়েছেন যা বুকের উপর পাথর হয়ে চেপে থাকে, তাকে উৎখাত করাই বাঞ্চনীয়। তিনি শিখিয়েছেন, জীবন যখন মানবেতর, তখন ভয় আসলে একটি বিভ্রম। ভয়হীন হয়ে গর্জে ওঠাতেই প্রগতির অঙ্কুর পরিপুষ্ট হয়।