এক নজরে

বাংলার বিপ্লবীদের চিঠি

By admin

January 26, 2023

চিঠি।ছোট্ট একটি শব্দ কিন্তু ব্যাপ্তি বিশাল।অনেক আশা আকাঙ্খা ভালোবাসা আবার হতাশা যন্ত্রণা সবই এক শব্দটির মধ্যে রয়ে গেছে। সাহিত্যের একটি পৃথক শাখাই গড়ে উঠেছে চিঠিকে কেন্দ্র করে।পত্রসাহিত্য-যা সময়েরও বড় দলিল বলা চলে।কোন সময়কে বা ব্যক্তিকে জানবার জন্য,  চিঠির জুড়ি মেলা ভার।গল্প উপন্যাসে অনেক সময় লেখকের নিজস্ব কল্পনার রঙ মিশে থাকে,  সেক্ষেত্রে পত্রসাহিত্যকে অনেক বাস্তবমুখী বললে বোধহয় অত্যুক্তি হবে না। এ প্রসঙ্গে বিখ্যাত বিদেশী সাহিত্যিক Emily Dickinson এর একটি মন্তব্য উল্লেখ্য ” A letter always seemed to me like immortality because it is the mind alone without corporeal friend.”

আমাদের আলোচ্য চিঠিগুলি অধিকাংশই জেল থেকে লেখা,ফলত, এই চিঠি লেখাতেও ছিল অনেক বিধিনিষেধ।এমনকি অনেকসময়েই সেই লিখিত চিঠির উপর আবার কলম চালানো হত।’ব্যক্তিগত স্বাধীনতা’ বলে কোন বিষয় সেখানে বিবেচনাধীন ছিল না।অবশ্য আমাদের বাংলামায়ের সেই দামাল ছেলেরাও কম ছিলেন না,প্রায়শই এমন হেঁয়ালিপূর্ণ চিঠি লিখতেন যে ইংরেজ বা তাদের তল্পিবাহকদের ক্ষমতা ছিল না, তা ধরতে পারেন।এইসব সাংকেতিকভাষা নিয়ে পরে অনেক অনিসন্ধিৎসু মানুষ গবেষণাও করেছেন।

অগ্নিপুত্রদের এই সকল চিঠিপত্র পর্যবেক্ষণ করলে, আরেকটি যে বিষয় নজরে আসে তা হলো, ভাষা।অনেক চিঠিই পড়তে গিয়ে আমাদের বারবার থামতে হয়, শুধু এই ভাবনাটুকু ভাবতে যে, মানুষটির মধ্যে একজন কত বড়ো কবি লুকিয়ে ছিল।যেমনি অসাধারণ শব্দচয়ন তেমনি বর্ণনা। এই প্রসঙ্গে ময়মনসিংহ ও ঢাকা নিবাসী প্রখ্যাত বিপ্লবী জ্যোতিষচন্দ্র জোয়ারদারের একটি চিঠির উল্লেখ না করে পারিনা।ইতিহাস বলছে বক্সা ও রাজশাহী জেলে বন্দী থাকাকালীন তিনি নিয়মিত চিঠি লিখতেন, যার প্রতিটিই সাহিত্যরস সম্পূর্ণ যদিও জেলের সেন্সরশিপের কারনে অনেক সময়েই প্রাপকের নাম রয়ে গেছে অজানা।এই প্রবন্ধের স্বল্প পরিসরে পুরো চিঠি তুলে দেওয়া সম্ভব নয়, তাই সামান্যই তুলে দিলামঃ

“…গোলাপ, জুই,রজনীগন্ধা আর সবাই যেন অন্তরের সকল সৌন্দর্য ঢেলে দিয়েছে সবুজের উৎসবে। কিন্তু রাজার দেখা নেই আজো।মালি চুপি চুপি সব গাছেদের কানে কানে কয়, গর্বে মরে যাই ভাই তোদের দেখে। রোজ এমনি করে সেজে থাকিস ভাই উৎসবের সাজে। পাগলা রাজা কবে কোন নিশি শেষে কি বেশে এসে হাজির হয় ঠিক নেই তার কোন। মায়ের পূজার বোধন লগ্নে তাকে আসতেই হবে। মন্ত্র পড়ে দু’হাত ভরে দেবে অঞ্জলি মায়ের পায়ে। মায়ের মুখে ফুটবে হাসি। ফুলেরা সব অধীর মধুর আগ্রহে গুনগুনিয়ে বলে ওঠে-কবে, কবে, কবে? “

একইভাবে মনে দাগ কেটে যায় বীরবিপ্লবী দীনেশ গুপ্তের লেখা চিঠি কটি।অসংখ্য চিঠির মধ্যে মাত্র খান দশেক চিঠি উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে।মা, বৌদি,ভাই ইত্যাদিকে লেখা চিঠিগুলিতে এই অসমসাহসী মানুষটি নানাভাবে তাঁর কাছের মানুষকে সান্ত্বনা দিয়েছেন, চেষ্টা করেছেন তাঁদের শোক প্রশম করবার আবার কখনো কখনো তাঁর নিজ হৃদয়ের ঐকান্তিক আর্তিটিও ধরা ভরেছে, যেখানে তিনি আবার ফিরে আসতে চেয়েছেন এই বাংলা মায়ের কোলে।এরকমই একটি চিঠিতে লিখছেন স্নেহের ভাই বল্টুকেঃ

“শীতের কুজ্ঝটিকার সঙ্গে সঙ্গে আমার দিনও ফুরিয়ে এল।আমায় ভুলো না ভাই।শীতের পুনরাগমনের সঙ্গে আমিও আবার তোমাদের মধ্যে ফিরে আসব।উত্তুরে বাতাসের পরশ পেলে মনে করো, আমি এসেছি তোমাদের আলিঙ্গন করতে,তোমাদের ভালবাসা কুড়িয়ে নিতে।”

কাকোরী রেল-ডাকাতি ও দক্ষিণেশ্বর বোমা মামলায় ফাঁসির আদেশ হয়েছিল বিপ্লবী রাজেন্দ্রনাথ লাহিড়ীর।ইতিহাসে এম.এ পাঠরত এই ছাত্রটির কী মনোভাব ছিল সে সম্পর্কে, তা ধরে পড়ে তারই লিখিত চিঠির প্রতিটি ছত্রেঃ

আমাদের কাছে মরা বাঁচা পুরনো কাপড় বদলানোর চেয়ে বেশি কিছু নয়, মৃত্যু আসছে,হাসতে হাসতে অত্যন্ত আনন্দের সংগে ফাঁসির দড়ি গলায় পরে নেব।জেলের আইন অনুযায়ী আর কিছু লিখতে পারবো না।আপনাকে নমস্কার  দেশবাসীকে নমস্কার। বন্দেমাতরম।

অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, আজ যখন চারিদিকে দিকে তাকাই তখন মনে হয়, এই সকল মহান মানুষের বলিদানের যথাযথ মূল্য আমরা কোনভাবেই দিতে পারিনি। তাইতো চিঠির মতোন এই মানুষগুলিও আমাদের মন থেকে,আমাদের ইতিহাস থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে।