এক নজরে

বাঁহাতি শিল্পী এবং বিজ্ঞানী লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি

By admin

July 29, 2025

অনেক গবেষকদের ধারণা, লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি ‘সব্যসাচী’ ছিলেন। কিন্তু এই ধারণার পুরোপুরি সত্যতা মেলে না। তবে তিনি যে বাঁহাতি ছিলেন তা স্বীকৃত। উল্লেখ করার বিষয় হল লিওনার্দো কেবল বাঁ হাতেই লিখতেন না, বরং ডান দিক থেকে শুরু করে বাঁ দিকে উল্টো হরফেও লিখতেন! সেই লেখাকে আয়নায় ধরলে তবেই ঠিকঠাক পড়তে পারা যায়। এী লেখার ধরনকে ‘মিরর রাইটিং’ বলা হয়। ধারণা করা হয়, লিওনার্দো অনেক ক্ষেত্রেই ইচ্ছাকৃতভাবেই এই ‘মিরর রাইটিং’-এ লিখতেন। এই বিশেষ পদ্ধতিতে লেখার মূল কারণ ছিল অন্যদের কাছ থেকে নিজের নতুন আবিষ্কার, জ্ঞান গোপন রাখা। কেউ চাইলেই সহজে যাতে লিওনার্দোর আবিষ্কার নকল বা চুরি করতে না পারে, তাই নিজেই এই কৌশল ব্যবহার করতেন। এরপরও লিওনার্দো বেশ লুকিয়েই অতি যত্নে সংরক্ষণ করতেন তার সমস্ত আবিষ্কারের লেখাপত্র। ১৯১০ সালে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি: আ মেমোরি অব হিজ চাইল্ডহুড বইটি প্রকাশিত হয়। অনেক দিন ধরে ভিঞ্চিকে নিয়ে ফ্রয়েডের আগ্রহ ছিল। ১৮৯৮ সালের ৯ অক্টোবর তিনি ফ্লিয়েসকে এক চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘সম্ভবত দুনিয়ার সবচেয়ে বিখ্যাত বাঁ হাতি ব্যক্তি হলেন লিওনার্দো, তার কোনো প্রেমের সম্পর্ক ছিল এমনটা জানা যায় না।’ তবে একথা ঠিক নিজের জীবদ্দশায় নানা কৌশলে নিজের সমস্ত কিছুকে গোপন রাখতে চেয়েছিলেন লিওনার্দো। তিনি বুঝেছিলেন, তাঁর এই ডায়েরি শুধু লেখা নয়, একেকটি ডায়েরি একেকটি গুপ্তধনের সমতুল্য। তাই লিওনার্দোর মৃত্যুর বহু বছর পর প্রাথমিকভাবে ডায়েরিগুলি জাদুঘরের সম্পদ হিসেবেই ছিল।

‍র‍্যাচেল এ. কোয়েস্টলার-গ্র্যাক “লিওনার্দো দা ভিঞ্চিঃ আর্টিস্ট, ইনভেস্টর অ্যান্ড রেনেসাঁ ম্যান” বইতে লিখেছেন, “তার নোটবুকের পর্যবেক্ষণগুলি এমনভাবে লেখা হয়েছিল যে কেবল আয়নার সামনে বই ধরে রেখেই সেগুলি পড়া যেত”। ব্লগ ওয়াকার’স চ্যাপ্টারস এর একটি প্রতিনিধিত্বমূলক পাল্টা যুক্তি দেন, “আপনি কি সত্যিই মনে করেন যে লিওনার্দোর মতো একজন চালাক মানুষ তার নোট বই যাতে কেউ পড়তে না পারে তার জন্য এটি একটি ভাল উপায় বলে মনে করেছিলেন? এই আশ্চর্য প্রতিভাধর মানুষটি যদি সত্যি সত্যিই তাঁর নোটগুলি কেবল নিজের জন্য পাঠযোগ্য করে তুলতে চাইতেন, তাহলে তিনি এই উদ্দেশ্যে একটি সম্পূর্ণ নতুন ভাষা আবিষ্কার করতেন। আমরা এমন একজন ব্যক্তির কথা বলছি যিনি হেলিকপ্টার তৈরি হওয়ার আগেই প্যারাসুটের ধারণা করে ফেলেছিলেন।”

লিওনার্দোর আয়না লেখার সবচেয়ে বেশি দেখা অংশটি সম্ভবত ভিট্রুভিয়ান ম্যান  সম্পর্কে তার নোট, তাঁর অতি বিখ্যাত অঙ্কন যা মানবদেহের অনুপাতকে একটি বৃত্ত এবং একটি বর্গক্ষেত্র উভয়ের জ্যামিতিতে ফিট করে। লিওনার্দোর পরে আয়না লেখার অনেক উদাহরণ আছে, তাঁর স্বদেশী মাত্তেও জ্যাকোলিনির ১৭ শতকের রঙ সম্পর্কিত গ্রন্থ থেকে শুরু করে ১৮ ও ১৯ শতকের অটোমান সাম্রাজ্যের ক্যালিগ্রাফি পর্যন্ত আজকের অ্যাম্বুলেন্সের সামনের অংশ পর্যন্ত। এগুলির প্রত্যেকটিরই নিজস্ব কার্যকারিতা রয়েছে, কিন্তু কেউ কেউ মনে করেন যে লিওনার্দোর মতো কৌতূহলী মন কি কেবল দক্ষতা আয়ত্ত এবং ব্যবহারের আনন্দের জন্য উল্টো দিকে লিখতে চেয়েছিলেন।

লিওনার্দোর নোটবই ভর্তি ছিল অনেক অনেক নোট দিয়ে। মারা যাবার সময় তাঁর ৬,০০০ পাতার বেশি নোট ছিল। তবে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, ধর্ম, ইতিহাস আর সাহিত্য নিয়ে তাঁর বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না। ১৫১৩ সালে লিও চলে যান রোমে। সেখানে তিনি ছিলেন ৩ বছর। তাঁকে অনেক আশা নিয়ে সম্মান দিয়ে সেখানে রাখা হয়, কিন্তু এই ৩ বছর ছিল তার অকর্মণ্য জীবন। তাদের আশানুরূপ কিছুই করেননি তিনি, কেবল নোটবুকে বিজ্ঞান নিয়ে লিখে গেছেন। এরপর ফ্রান্সের রাজা ফ্রান্সিস দা ফার্স্ট লিওনার্দোকে তাঁর রাজকীয় চিত্রকর ও স্থপতি বানিয়ে দিয়ে তাঁকে রাজসভায় আহবান করেন। তাঁকে একটি বাগান বাড়িও উপহার দেন রাজা। ১৫১৯ সালে ফ্রান্সের সেই বাগানবাড়িতেই মারা যান লিওনার্দো দা ভিঞ্চি। লিওনার্দো অত্যন্ত মেধাবী হলেও, কিছু কিছু জিনিস আছে যেগুলি আসলেই তিনি আবিষ্কার করেননি, অথচ তাঁর নাম দিয়ে চালিয়ে দেয়া হয়। যেমন, ড্যান ব্রাউন তার ‘দ্য দা ভিঞ্চি কোড’ বইতে ক্রিপ্টেক্স নামক একটি যন্ত্রের কথা বলেছেন। সেটি মোটেও লিওনার্দোর উদ্ভাবন নয়।

যুদ্ধে লিওনার্দোর লেখা, কাগজ ও ডায়েরি নষ্ট হয়। ধারণা করা হয়, তাঁর জীবদ্দশায় ৩০টিরও বেশি ডায়েরি লিখেছিলেন। এই ডায়েরিগুলি যেমন সমৃদ্ধ ছিল বিজ্ঞান, চিত্রকলা, ভাস্কর্য, শল্য চিকিৎসা প্রভৃতি বিষয় নিয়ে, তেমনি নতুন সব আবিষ্কার ও তার ফলাফল নিয়ে। এই সব ডায়েরির মধ্যে ‘কোডেক্স লিস্টার’ (Codex Leicester)-কে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি জার্নাল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। লিওনার্দো ছিলেন প্রকৃতির শিষ্য। তাই সবকিছুকেই তিনি শিখতে ও বুঝতে চেয়েছিলেন হাতে-কলমে। পাশাপাশি মানুষ ও প্রাণীর শরীর নিয়ে কৌতূহল ছিল তার তীব্র। চামড়ার নিচের শরীরের সমস্ত কিছুই তিনি দেখতে চেয়েছিলেন একদম গভীর থেকেই। এই কৌতূহল ও আগ্রহ থেকে সিদ্ধান্ত নেন নিজেই শবদেহগুলোর ব্যবচ্ছেদ করবেন। ধারণা করা হয়, লিওনার্দো তার জীবদ্দশায় ৩০টির মতো শবদেহের ব্যবচ্ছেদ করেছিলেন নিখুঁতভাবে। এই ব্যবচ্ছেদগুলোর মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত তিনি লিখে রাখার পাশাপাশি অ্যানাটমির নিখুঁত বর্ণনাও এঁকে গিয়েছিলেন নিরলসভাবে। এই অ্যানাটমি ও তথ্য-উপাত্ত চিকিৎসা বিজ্ঞানের জগতে এক বিশাল পরিবর্তন নিয়ে আসে। তাই শুধু শিল্পের জন্যই নয়, বরং চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসেও গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ হিসেবে আজও সর্বজন সমাদৃত এ অ্যানাটমি। ব্যবচ্ছেদের জন্য লিওনার্দো ইতালির মিলান, রোম ও ফ্লোরেন্স শহরের হাসপাতালে নিয়মিত যাতায়াত করতেন। সেখানেই শবদেহের ওপর করতেন তিনি অস্ত্রোপচার। বিশ্ব প্রথম লিওনার্দোর মাধ্যমেই জানতে পারে, মানবশরীরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হচ্ছে মস্তিষ্ক, ফুসফুস ও হৃৎপিণ্ড। এ আবিষ্কার এখন পর্যন্ত বিজ্ঞানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার হিসেবেই স্বীকৃত।  

সারা বিশ্বে লিওনার্দো শিল্পী হিসেবেই পরিচিত ও সমাদৃত নিঃসন্দেহে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে লিওনার্দো তার সমস্ত জীবনে খুবই অল্পসংখ্যক কিছু শিল্পকর্ম সম্পূর্ণভাবে এঁকেছেন। ক্রমাগত নতুন টেকনিক ও গবেষণার ফলে অনেক শিল্পকর্মই সময়ের সঙ্গেসঙ্গে হারিয়ে যায়। এছাড়া যুদ্ধের কারণে নষ্ট হয় তার আরো কিছু মাস্টারপিস। এখন পর্যন্ত সাকল্যে লিওনার্দোর ২০টির মতো চিত্রকর্মের সন্ধান পাওয়া যায়।