এক নজরে

সিংহাসন ছেড়ে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য হলেন জৈন সন্নাসী

By admin

November 18, 2021

সেদিনের ওই যুবক তখনও জানতেন না, গ্রীক বীরের চেয়েও বিশাল এক সাম্রাজ্য জয়ের মুকুট তাঁর মাথায় উঠতে চলেছে। আর মাত্র কিছুকালের অপেক্ষা। হলও ঠিক তাই, আলেকজান্ডারের সঙ্গে সেই সাক্ষাতের কয়েক বছরের মধ্যেই ভারতবর্ষের বুকে কালজয়ী ইতিহাস রচনা করেন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য।এখানেই শেষ নয়, বলা যায় এই গল্পের শুরু। যেখানে আলেকজান্ডার শেষ করলেন, সেখান থেকে শুরু করলেন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য।

ঐতিহাসিকদের ধারণা, চন্দ্রগুপ্ত শিক্ষক চাণক্যের পরামর্শেই তক্ষশীলার অভিযান প্রায় শেষ করে আসা আলেকজান্ডারের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। কারণ  হিসাবে মনে করা হয়, মগধের রাজাকে পরাজিত করার সহযোগীতা চাইতেই চন্দ্রগুপ্ত আলেকজান্ডারের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। তবে তাঁকে শূন্য হাতে ফিরতে হয়েছিল। কারণ তখন আলেকজান্ডারের কাছে চন্দ্রগুপ্ত ছিলেন নাম না জানা এক সাধারণ প্রজামাত্র।

অথচ যে মগধ অধীশ্বরের মুখোমুখি না হয়েআলেকজান্ডার ফিরে গেলেন, সেই নন্দরাজ এই অসম সাহসী তরুণের কাছে পরাজিত হয়ে মগধ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হলেন। আর নিজের দক্ষতায় মগধের মুকুট নিজের মাথায় পরে নিলেন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য।এক সাধারণ তরুণ থেকে হয়ে ওঠেন এক দুর্দমনীয় রাজা, গড়ে তোলেন উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্য, মৌর্য সাম্রাজ্য।

যদিও এই জয় খুব সহজ ছিল না। তাঁর নিজের সৈন্যদলের নন্দভীতির কারণে আলেকজান্ডার ভারতবর্ষ জয় অসম্পূর্ণ রেখেই ফিরে যান এবং ফেরার পথে প্রচন্ড অসুস্থ হয়ে ব্যবিলনে মারা যান। আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর সুযোগ হাতছাড়া করতে চাননি চাণক্য কিম্বা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য। শক্তিশালী ধননন্দের সঙ্গে প্রথম দু’দফা যুদ্ধে পরাজিত হয়েও চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য মোটেও দমে যান নি। তৃতীয় দফায় নতুন উদ্যমে যুদ্ধে নামেন এবং মগধের মুকুট ছিনিয়ে নেন। রাজ্য হারিয়ে পরাজিত ধননন্দ পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।

তামিল ও কলিঙ্গ বাদে এই উপমহাদেশের প্রায় সব অঞ্চলই চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। বলা যায়, ভারতবর্ষের ইতিহাসে এর চেয়ে বড় সাম্রাজ্য আর গড়ে ওঠে নি। ঐতিহাসিকদের মতে, মগধরাজের অপমানের প্রতিশোধ নিতেই চাণক্য পাটালিপুত্রের ১৫০০ কিলোমিটার দক্ষিণের একটি গ্রাম থেকে আসা পিতৃহীন চন্দ্রগুপ্তকে শিষ্য করেছিলেন। তক্ষশীলায় পড়াশোনা করার সময় মাত্র ২০ বছর বয়স থেকেই চন্দ্রগুপ্ত চাণক্যের সংস্পর্শে রাষ্ট্র পরিচালনা, দিগ্বীজয়ের কৌশল, সৈন্য সংগ্রহ, যুদ্ধ প্রশিক্ষণ এবং ভারতবর্ষের স্বাধীনতাকে অক্ষুণ্ণ রাখার উপায় সম্বন্ধে শিক্ষালাভ করেন। চাণক্যই ছিলেন রাজা চন্দ্রগুপ্তের প্রধানমন্ত্রী।

ক্ষমতার একেবারেশীর্ষে অবস্থানকালে, জীবনে যা কিছু চেয়েছিলেন তার প্রায় সবটাই যখন অর্জিত হয়ে গিয়েছে, তখন হটাৎ একদিন উচ্চাভিলাসী রাজা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য বিশাল সাম্রাজ্য ত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন। জৈনগ্রন্থ রাজাবলীকথা অনুসারে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য ভদ্রবাহুর প্রভাবে আচ্ছন্ন হয়ে জৈন ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। যদিও চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের ধর্ম নিয়ে মতভেদ আছে। তিন ধর্মে তাঁকে তিনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। বৌদ্ধ ধর্মে বলা হয়, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য ক্ষত্রিয় গোত্রের অন্তর্ভুক্ত এবং একটি ছোট রাজ্য থেকে এসেছিলেন, কিন্তু পরবর্তীতে তাঁর বাবার মৃত্যুর পর তিনি একজন শিকারীর কাছে পালিত হন। জৈন ধর্মে বলা হয়, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য হিমালয়ের পার্বত্য রাজা পর্বতেশ্বর বা পর্বাতক বা পুরুষোত্তমের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ছিলেন। অন্যদিকে হিন্দু পুরাণ বলে, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য শুদ্র জাতোদ্ভব ছিলেন।তাঁর রাজত্বের শেষদিকে উত্তর ভারতে এক দারুণ দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে চন্দ্রগুপ্ত প্রাণের সিংহাসন ছেড়ে ক্লান্ত-শ্রান্ত রাজা তার গুরুর সাথে দক্ষিণের কর্ণাটকে পাড়ি জমান। মহীশুরের অন্তর্গত শ্রাবণবেলগালোয় তিনি জৈন সাধু-সন্ন্যাসীর মতো জীবনযাপন করেন। বিধাতার খোঁজে বেরিয়ে পড়া দিগ্বীজয়ী রাজা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য জৈন ধর্মাচার ‘স্বেচ্ছা উপবাস’ শুরু করেন এবং তপস্যারত অবস্থায় মারা যান।