ঘুরে-ট্যুরে

পাখিদের স্বর্গরাজ্য ঘুমন্ত গ্রাম লাটপাঞ্চার

By admin

August 30, 2020

ভোরবেলায় পাখির কিচির মিচির কানে এলে মনে হয় সত‍্যিই অন্ধকারের শেষে ভোরের আলো ফুটল। মনটা চাঙ্গা হয়ে ওঠে। নিঃঝুম দুপুরে যখন শরীর-মন দুই ই অবসন্ন,তখন হঠাৎ যদি সামনের কোন গাছে নাম না জানা রঙীন পাখি দেখতে পাওয়া যায় বা তার সুরেলা কন্ঠ কানে আসে ,হাজার ক্লান্তির মাঝেও উদাসী মন পাখির মত উড়ে হারিয়ে যেতে চায়। মনের এই ইচ্ছেটাকে চেপে না রেখে ব‍্যস্ততার মাঝেও একটু সময় করে চলে আসুন পাখির দেশ লাটপাঞ্চারে। চলে এলেই ব‍্যস্—কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা মনে মনে–। তবে এখানে এলে সত‍্যি সত‍্যিই প্রকৃতির নির্জনতা আর রং বেরং এর পাখির কলতান আপনাকে অন‍্য এক জগতে পৌঁছে দেবে।আসুন,চলে আসুন, একটু সময় করে। বেশি দূর নয়,নিউ জলপাইগুড়ি থেকে মাত্র ৪২ কিলোমিটার। পৌঁছাতে সময় লাগে ঘণ্টা দেড়েক।

জলপাইগুড়ি থেকে শিলিগুড়ি হয়ে শালুগাড়ার সেনা ছাউনির পাশ দিয়ে এগিয়ে যেতে যেতে শুরু হবে মহানন্দা অভয়ারণ‍্য। সেখানে শাল, সেগুনের জঙ্গলের মধ‍্যে দিয়ে সেবক রোড হয়ে তিস্তার পাড় ধরে এগিয়ে যেতে হবে। মাঝে পড়বে সেবক কালীবাড়ী, তিস্তার ওপর বিখ‍্যাত করোনেশন ব্রিজ।ওখান থেকে কালীঝোড়া হয়ে বাঁ দিকে উঠে গিয়েছে সরু একটি রাস্তা। সে পথে মাত্র ১০ কিমি দূরে লাটপাঞ্চার। শেষ কয়েক কিলোমিটার রাস্তা বেশ খাঁড়া। ৪২০০ ফুট উঁচুতে এই জনপদ । লাটপাঞ্চার-ই মহানন্দা অভয়ারণ্যের উচ্চতম এলাকা। অভয়ারণ্যের অন্তর্গত এলাকা হওয়ায় এখানে নানা ধরণের পাখি ছাড়াও দেখা মেলে বিভিন্ন পশুরও। বার্কিং ডিয়ার, বুনো শুয়োর এমনকি চিতা বাঘের দেখাও মিলতে পারে।

লাট মানে বেত আর পাঞ্চার মানে জঙ্গল। এখানে রয়েছে বিস্তৃত সিনকোনা বাগান। প্রায় ১ হাজার ৪০০ একর জায়গা জুড়ে। গ্রামবাসীদের বেশির ভাগই সিনকোনা বাগানে নানাবিধ কাজে এবং চাষাবাদের কাজেই যুক্ত। পর্যটকদের আনাগোনা আগের তুলনায় বাড়লেও, পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে এখনো ততটা জনপ্রিয় হয়নি লাটপাঞ্চার। তবে এখানে থাকার জন‍্য গড়ে উঠেছে কয়েকটি হোম স্টে। ন্যুনতম সব সুবিধাই মেলে সেখানে। হোম স্টে গুলোতে বাহুল্য না থাকলেও আন্তরিকতা আছে। তাতে কোনো ঘাটতি নেই।আগে থেকে বলা থাকলে হোম স্টের গাড়িই নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে নিয়ে যাবে লাটপাঞ্চারে। প্রায় চার কিলোমিটার নিচে জঙ্গলের মধ্যে রয়েছে ব্রিটিশ আমলে তৈরি একটি বন বাংলোও। সেখানে রয়েছে যথেষ্ট সুসজ্জিত দুটো ঘর। একসময় ব্রিটিশ সাহেবেরা সিনকোনা বাগান তদারকির কাজে এসে সেখানে থাকতেন।

ছবি: তরুণ রায় চৌধুরী

এখানে এলে প্রকৃতির নির্জন রূপকে উপলব্ধি করা যায়। মেঘলা দিনে এ যেন এক ঘুমন্ত গ্রাম। কুয়াশা ঘেরা গ্রামটিকে দেখলেও মনে হয় এখনো তার ঘুম ভাঙেনি। বর্ষায় সে ভীষণ সবুজ। রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে তার অন্যরূপ। শীতে বেশ ঠান্ডা। তাই বছরের যে কোনো সময়েই আসা যায় লাটপাঞ্চার। ছোট্ট পাহাড়ি জনপদ হলেও দেখে আশ্চর্য হবেন সেখানে রয়েছে তিনটে ইংরেজি মাধ্যম স্কুল। স্থানীয় বাচ্চারা সেখানেই পড়ে।

প্রকৃতির নির্জনতা আর পাখির কলতানের এক আশ্চর্য যুগলবন্দি লাটপাঞ্চারে। এখানে এলে ধনেশ পাখি,নীল কটকটিয়া,লং টেইলড ব্রডবিল,রাজঘুঘু, আলতাপরি-এরকম কত নাম না জানা পাখির দেখা মিলবে।মহানন্দা অভয়ারন‍্যে প্রবেশ করলে আরো অনেক পাখি ,জায়েন্ট ব্ল্যাক স্কুইরেলও দেখতে পাওয়া যাবে। ২৪০ রকমের প্রজাতিরপাখি আছে এখানে।ভাগ‍্য ভালো হলে দেখা মিলতে পারে বেলিড ঈগলের যা এখন লুপ্তপ্রায়। পায়ে হেঁটেই সিনকোনা বাগান বা জঙ্গলের খানিকটা ঘুরে দেখতে পারেন। নিতে পারেন গাড়িও। এখান থেকে আরো পাঁচ কিলোমিটার উঁচুতে অহলদাঁড়া। গাড়ি নিয়ে যেতে পারেন অহলদাঁড়া ভিউ পয়েন্টে। সেখান থেকে সূর্যোদয়, কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখাও দারুন আকর্ষণীয়। নিচ দিয়ে বয়ে চলেছে তিস্তা। দূরে গ্যাংটক, কালিম্পঙ শহর। জানুয়ারী ,ফেব্রুযারী মাসে উপরি পাওনা পাশের পাহাড়ের হলুদ হয়ে থাকা কমলালেবুর বাগান দেখতে পাওয়া। সব মিলিয়ে জঙ্গল,পাখির কলতান, কুয়াশায় ঢাকা পাহাড় আপনাকে নিয়ে যাবে স্বপ্নের রাজ‍্যে।