এক নজরে

প্রয়াত চিত্রগ্রাহক সৌম্যেন্দু রায়

By admin

September 27, 2023

সত্যজিৎ রায়ের ‘তিনকন্যা’র মণিহারা-য় কঙ্কালরূপী মণিমালিকাকে দেখে শিউরে ওঠেন নি, এমন দর্শক খুঁজে পাওয়া যাবে না, কিংবা মরুভূমির হলুদ পটভূমিতে কয়লার ধোঁয়ার ট্রেন থামাতে প্রদোষ মিত্তির ব্যর্থ হলে হতাশ হন নি, এমন কেউও মিলবে না। এই সব দৃশ্য পরিকল্পনা সত্যজিতের হলেও তাকে সত্যিকারের বাস্তবায়িত করার কাজটি কিন্তু করেছিলেন যে আলোকচিত্রী তিনি সৌমেন্দু রায়। কেবল তাই নয়, ‘পোস্টমাস্টার’-এ মেঘলা আলো, ‘মণিহারা’-য় রহস্যঘন আলো এবং ‘সমাপ্তি’-তে ঝকঝকে উজ্জ্বল আলোয় তিনি প্রমাণ করে দিয়েছিলেন যে আলো আঁধার রচনা করার মুন্সিয়ানায় তিনিও কমতি নন। কেবল তিনটি আলাদা গল্পের জন্য তিন রকমের আলোক পরিকল্পনাই নয়, ‘অভিযান’ ছবিতে রাতের বেলায় গাড়ির মধ্যে সাধারণ আলো ব্যবহার করে যে নিখুঁত আলোকময় পরিবেশ তৈরি করেছিলেন, ‘গুপি গাইন বাঘা বাইন’ ছবিতে একের পর এক গা ছমছমে পরিবেশ তৈরি করে স্বাধীন আলোকচিত্রী হিসেবে তিনি সাদা কালো ছবিতে আলোছায়ার দৃশ্য রচনায় নজির গড়েছিলেন।

সত্যজিৎ রায়ের সিনেমার আলোচনায়, নিশ্চিতভাবে উঠে আসে একাধিক নাম, তবে তাঁদের মধ্যে দুটি নাম বারবার এসে পড়ে, তাঁরা হলেন সুব্রত মিত্র ও সৌম্যেন্দু রায়।  সত্যজিতের প্রথম দিকের বেশ কয়েকটি সিনেমার চিত্রগ্রাহকের দায়িত্বে ছিলেন সুব্রত মিত্র। তাঁর সূত্রেই সৌম্যেন্দু রায় জড়িয়ে পড়েন সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’থেকেই। সুব্রত মিত্র-এর চোখের সমস্যা হওয়ায় সত্যজিৎ রায় ডেকে পাঠান সৌম্যেন্দু রায়কে, ‘রবীন্দ্রনাথ’ তথ্যচিত্রে চিত্রগ্রহণের জন্য। একইসঙ্গে ডাক পেলেন ‘তিনকন্যা’-র জন্য। তারপর থেকে কাজ করেছেন সত্যজিৎ রায়ের অন্তত ১৫টি সিনেমা-সহ আর অসংখ্য চলচ্চিত্রে। একাধিকবার মিলেছে জাতীয় পুরস্কার। অবশেষে ক্যামেরার মায়াবী স্পর্শে দর্শকদের মুগ্ধতাকে সঙ্গী করেই শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন সৌম্যেন্দু রায়। দীর্ঘদিন ধরেই ভুগছিলেন বার্ধক্যজনিত সমস্যায়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল একানব্বই বছর।

ছোটোবেলা থেকেই ছিলেন পড়াশোনায় অত্যন্ত মেধাবী। একই সঙ্গে ভালোবাসা জন্মায় ক্যামেরার প্রতি। উপহার পাওয়া ক্যামেরা নিয়ে নানারকম পরীক্ষায় মেতে থাকতেন দীর্ঘসময়। ক্রমে যাতায়াত শুরু করেন টলিপাড়াতেও, আলাপ হয় বর্ষীয়ান চিত্রগ্রাহক রামানন্দ দাশগুপ্তের সঙ্গে। ১৯৫৫ সালে বাংলা সিনেমার সঙ্গে সঙ্গে বাঁকবদল ঘটল তাঁরও জীবনের। ‘পথের পাঁচালী’সিনেমার সহকারী কলাকুশলীর দায়িত্বে থাকাকালীন পান সত্যজিৎ রায়, সুব্রত মিত্র ও বংশী চন্দ্রগুপ্তের সাহচর্য। প্রায় সকলেই সেই সিনেমায় নবাগত। তবু তার মধ্যেই পেয়েছিলেন অভিনবত্বের স্বাদ। সেই সান্নিধ্য তাঁকে ভবিষ্যতে সাহায্য করেছিল একজন সার্থক সিনেম্যাটোগ্রাফার হয়ে উঠতে।

সত্যজিৎ রায় ছাড়াও তপন সিনহার তিনটি ছবিতে চিত্রগ্রহণের কাজ করেন সৌম্যেন্দু রায়। তরুণ মজুমদার, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, উৎপলেন্দু চক্রবর্তীর ছবিতেও রয়েছে তাঁর ক্যামেরার কাজ। বাংলা ছবির বাইরে ১৯৮২ সালে তামিল পরিচালক শ্রীধর রাজনের ছবিতে চিত্রগ্রহণের জন্য তামিলনাড়ুর স্টেট ফিল্ম অ্যাওয়ার্ডের সম্মানেও ভূষিত হন। এছাড়া বেশ কয়েকটি তথ্যচিত্রেও সিনেম্যাটোগ্রাফারের দায়িত্বপালন করেন তিনি। যার মধ্যে ১৯৯৩ সালে রাজা সেনের ‘সুচিত্রা মিত্র’ তথ্যচিত্রের জন্য ‘নন-ফিচার’ সিনেমার শ্রেষ্ঠ চিত্রগ্রাহকের খেতাব অর্জন করেন। তাঁর জীবনকে কেন্দ্র করে ‘প্রোর্ট্রেট অফ এ সিনেম্যাটোগ্রাফার’ এবং ‘সৌম্যেন্দু রায়’ নামের দুটি তথ্যচিত্রও নির্মিত হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ তথ্যসম্প্রচার মন্ত্রকের ‘রূপকলা কেন্দ্র’-এর সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন দীর্ঘসময়।