অষ্টাদশ শতাব্দীতে ফরাসী বিজ্ঞানী পিয়েরে সায়মন ল্যাপলাস এক দৈত্যকে হাজির করলেন যে ভবিষ্যতের সমস্ত ঘটনার কথা বলে হুবহু দেবে। সে এমন ভবিষ্যদ্বাণী করবে যা মহাবিশ্বের প্রতিটি কোণে আগামী দিন ঘটবে। পদার্থবিজ্ঞানে সেই বিজ্ঞানী ল্যাপলাসের দৈত্য নামে পরিচিত।
ল্যাপলাস জন্মেছিলেন ১৭৪৯ সালে। তাঁর আমলে পরমাণুকে মৌলিক কণা ধরা হত, তবে পরমাণু কি দিয়ে তৈরি তা কারও জানা ছিল না। ল্যাপলাস মনে করতেন যে, মহাবিশ্বের সব পরমাণুর অবস্থান এবং গতিবেগ যদি এই মুহূর্তে জানা থাকে, তবে পদার্থবিদ্যার নিয়মকে অনুসরণ করে মহাবিশ্বের অতীত এবং ভবিষ্যৎ নির্ভুলভাবে বলে দেওয়া সম্ভব। সবকিছুই যেহেতু মহাবিশ্বের একটি অংশ, তাই জন্ম, মৃত্যু সবই অঙ্ক কষে বলে দেওয়া যাবে। মহাবিশ্ব এবং সেই সঙ্গে আমাদের ভবিষ্যৎ পূর্বনির্ধারিত। এমন অঙ্ক দ্রুত করার জন্য চাই একটি অতিমানবীয় বুদ্ধিমান সত্তা। তাই ল্যাপলাসের দৈত্য। ল্যাপলাসের দৈত্যকে একটি সুপার কম্পিউটার হিসাবে ভাবা যেতে পারে! এমন একটি কম্পিউটার যার ইনপুট হবে এই মুহূর্তে মহাবিশ্বের প্রতিটি পরমাণুর অবস্থান, গতি, কোয়ান্টাম দশা এবং পদার্থবিদ্যার নিয়ম। এই ইনপুট থেকে অঙ্ক কষে কম্পিউটারটি মুহূর্তে জানিয়ে দেবে মহাবিশ্বের এবং আমাদের জন্ম, মৃত্যু, অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ। কিন্তু ল্যাপলাসের এই পরিপূর্ণ নিখাঁত জ্ঞানের তত্ত্ব বেশিদিন টেকেনি। তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্র, হাইসেনবার্গের কোয়ান্টাম অনিশ্চয়তা তত্ত্ব সমেত সব খবর মনে রাখার মতো এবং দ্রুত গণনার মতো কম্পিউটারের অবাস্তবতা, ল্যাপলাসের দৈত্যের মৃত্যু ঘটায়।
মহাবিশ্বে গ্যালাক্সির সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার কোটি। একেকটি গ্যালাক্সিতে আবার কয়েক হাজার কোটি নক্ষত্র। গোটা মহাবিশ্বে নক্ষত্র, গ্রহ, উপগ্রহ ইত্যাদির সংখ্যা বের করা শুধু কঠিনই নয়, প্রায় অসম্ভব। প্রতিটি গ্রহে, প্রতিটা উপগ্রহে, প্রতিটা নক্ষত্রে প্রতি মুহূর্তে কত ঘটনা ঘটছে। সামান্য একটা ব্যাকেটিরায় দেহেই ঘটছে কত ঘটনা। মানুষের কথা তো ছেড়েই দেওয়া যায়। চলছে পরমাণুর ভেতরে ইলেকট্রন আর নিউক্লিয়নদের মধ্যেও কত কত অ্যাকশন-রি অ্যাকশন। শুধু পৃথিবীর মাত্র এক মুহূর্তের ঘটনার হিসাব কি কষা সম্ভব? সম্ভব নয়। পৃথিবীর পাঁচশো কোটি বছরের হিসাব রাখা আরও কঠিন। সেখানে গোটা মহাবিশ্বের ১৩.৮ বিলিয়ন বছরে প্রতিটি গ্যালাক্সিতে, নক্ষত্রে, গ্রহে, মহাজাগতিক বস্তুতে, প্রতিটা পরমাণুতে ঘটে যাওয়া ঘটনার হিসাব রাখবে কে? এত হিসাব রাখা কী সম্ভব? ল্যাপল্যাস বলেছিলেন, এই দৈত্যের পক্ষে সম্ভব মহাবিশ্বের জীবনের ইতিহাসে যত ঘটনা ঘটেছে, সব ঘটনার হিসাব রাখা। সত্যিই যদি এমন কোনো দৈত্য থাকে বা তৈরি করা সম্ভব হয়, তাহলে সেই দৈত্যের পক্ষে সম্ভব মহাবিশ্বে ভবিষ্যতে কী ঘটবে তার সকল ঘটনার জবাব দেওয়ার।
ল্যাপলাসের দৈত্যকে মানুষ বা প্রাণীই হতে হবে তার কোনো মানে নেই। সেটা যন্ত্র হলেও চলবে। হতে পারে সেটা সুপার কম্পিউটার। কিন্তু সেই সুপার কম্পিউটারই কি অতীতের সব হিসাব কষে রাখতে পারে? পারে না। কারণ, তাপগতিবিদ্যার সূত্র। আরো নিশ্চিত করে বললে শক্তির সংরক্ষণশীলতা নীতি।শক্তির সংরক্ষণশীতা নীতি, যেটাকে আবার কার্নোর ইঞ্জিন তত্ত্ব থেকে বলা যায়, দুনিয়ায় এমন কোনো যন্ত্র তৈরি সম্ভব নয় যে শতভাগ দক্ষতায় কাজ করতে পারে।সুতরাং এটা নিশ্চিত যত চেষ্টাই করা হোক, এমন কোনো যন্ত্র বা দৈত্য তৈরি করা সম্ভব নয় যে মহাবিশ্বের অতীতের সব ঘটনার হিসাব রাখবে। আবার যত হিসাব কষবে সেগুলোরও শতভাগকে সে আউটপুট হিসেবে বের করতে পারবে না। অর্থাৎ সব ঘটনার হিসাব থেকে সবগুলোর হিসাবকেই ভভিষ্যদ্বাণীতে রূপান্তরিত করতে পারবে না। কিছু তথ্য হারিয়ে যাবে তার যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে। তাই ল্যাপলাসের দৈত্য তৈরি করা কখনোই সম্ভব হবে না, অন্তত আমাদের মহাবিশ্বে পদার্থবিদ্যার যে নীতি রয়েছে, সে অনুযায়ী এমন দৈত্যের জন্ম হবে না কখনো।