এক নজরে

পরিচারিকা থেকে সুপারস্টার

By admin

April 23, 2023

তাঁর জীবনকথা সত্যি এক চিত্রনাট্য। কেবল অভিনয় নয়, একই সঙ্গে মধু মাখা সুরেলা গানের গলা! বাংলা হিন্দি মিলিয়ে অসংখ্য চিরস্মরণীয় গান রেখে গিয়েছেন তিনি। তাঁর মায়া জড়ানো আশ্চর্য সুন্দর মুখশ্রএী এক ঝলক দেখার জন্য একই সঙ্গে তাঁর কন্ঠে গান শোনার জন্য সে যুগের প্রায় সব বয়েসের দর্শক শ্রোতার হৃদয় উথালপাথাল করে উঠতো। সেই কানন দেবীর জীবন শুরু হয়েছিল পরিচারিকা হিসাবে।

এক অদ্ভূত করুণ রাগে বাঁধা ছিল কানন দেবীর গোটা জীবন।উল্লেখ্য, তাঁর জন্মের সাল এবং তারিখ নিয়ে কোনও প্রামাণ্য নথি নেই। কেউ বলেন তাঁর জন্ম ১৯১৪ সালে। কারও মতে ১৯১৬ সালে। তবে তারিখটা ঠিক হয়েছে ২২ এপ্রিল। আরও আশ্চর্যের বিষয় নিজের পিতৃপরিচয়ও জানতেন না কানন দেবী। তাঁর আত্মজীবনী ‘সবারে আমি নমি’ এবং মেখলা সেনগুপ্ত-র লেখা ‘কানন দেবী: দ্য ফার্স্ট সুপারস্টার অফ ইন্ডিয়ান সিনেমা’বইয়ে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী রতনচন্দ্র দাস এবং রাজবালা দেবীকেই নিজের মা-বাবা বলে পরিচয় দিতেন কানন। ছোট্ট কাননকে এঁরাই মানুষ করার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। কাননের খুব অল্প বয়সেই রতনচন্দ্র মারা যান। মদ্যপান, জুয়া এবং রেসের নেশা তাঁকে বহুদিক থেকে সর্বস্বান্ত করেছিল। তবে বাবা-মায়ের পরিচয় নিয়ে সর্বসমক্ষে তেমন কিছু ভাবতেন না কানন। তিনি বহুবারই বলেছেন, ‘কে বাবা, কে মা, এই ভেবে বুকের ব্যথা বাড়িয়ে কাজ কী? আমি কানন, এই পরিচয়টুকুই তো যথেষ্ট।’ সত্যিই নিজের পরিচয়েই তিনি ভাস্বর ছিলেন।

খুব ছোট বয়স থেকেই পেট চালানোর জন্য বিভিন্ন বাড়িতে রাজবালার সঙ্গে পরিচারিকার কাজ করতেন কানন। ঠিকমতো খাওয়াও জুটত না। পরে নিজের পুত্রবধূ রুবিকে বলেছিলেন যে পেটে খিদে সারাক্ষণ চড়ে থাকত। কষ্ট সহ্য করতে না পেরে এক আত্মীয়ের বাড়িতে ঠাঁই নিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানেও চরম লাঞ্ছনা আর অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছিল। শেষমেশ সেখান থেকেও চলে যেতে হয় তাঁদের। হাওড়ার অখ্যাত ঘোলাডাঙা পল্লিতে জায়গা খুঁজে নেন রাজবালা আর কানন। খুব অল্প কিছু দিন রতনচন্দ্রের সান্নিধ্য পেলেও ওই ছোট বয়সে নানা ধরনের বই পড়া এবং গান শোনার অভ্যেসটি তৈরি হয়ে গিয়েছিল কাননের। গান শুনে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মুখে পাউডার লাগিয়ে নাচতেন ছোট্ট কানন।

কাননের সামনে সঙ্গীতের এক বিরাট জানালা খুলে দিয়েছিলেন ভোলাদা। আত্মজীবনীতে কানন জানিয়েছেন, অতুলপ্রসাদী থেকে মীরার ভজন গেয়ে শোনাতেন ভোলাদা। কখনও লালনের গানও শোভা পেত তাঁর গলায়। বালিকা কানন গানের মানে বোঝার জন্য পীড়াপীড়ি করতেন, খুব যত্ন নিয়ে মানে বুঝিয়ে দিতেন ভোলা। হঠাৎ একদিন উধাও হয়ে গেলেন ভোলা। সে সময় কাননের মস্ত বড় এক ভরসার জায়গা হয়ে উঠেছিলেন আশ্চর্যময়ী দেবী। নিজেও যেমন অপূর্ব কণ্ঠের অধিকারী ছিলেন, তেমনই বুঝেছিলেন কাননেরও কণ্ঠ একেবারে গানের জন্য তৈরি। তার উপর ছোট বয়সেই রূপের ছটা আকৃষ্ট করতে শুরু করেছিল অনেককে।

পাড়ারই এক কাকার হাত ধরে ১৯২৬ সালে ম্যাডান থিয়েটার্সের জয়দেব ছবিতে প্রথম অভিনয়ের সুযোগ আসে। সেই ছবি ছিল নির্বাক। সেই থেকে শুরু। ধীরে ধীরে সবাক ছবি ও গানের জগতে অশ্চর্য মায়াজাল গড়ে তুললেন কানন। ভোলাদার হাতে সঙ্গীতের হাতেখড়ি হয়েছিল। পরবর্তী কালে ওস্তাদ আলারাখা, পঙ্কজ মল্লিক, ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়, আখতারী বাই, ধীরেন্দ্রচন্দ্র মিত্র, দিলীপ রায়, নজরুল ইসলামের মতো মহান শিল্পীদের কাছে গান শিখেছেন। ওঁদের সান্নিধ্যে আরও পরিণত হয়েছিল তাঁর কণ্ঠ।

রবীন্দ্রনাথ সিনেমায় তাঁর গানের চিত্ররূপ অনুমোদন করলে সেই প্রথম গানটি ছিল কা ননের গাওয়া- ‘আজ সবার রঙে রং মেশাতে হবে’। গান নিয়ে করা প্রমথেশ বড়ুয়ার ছবি ‘মুক্তি’ দুরন্ত হিট হওয়ার পর হিন্দুস্তান রেকর্ডজে কবিকে প্রথম দেখা কাননের। প্রশান্তচন্দ্র মহালানবিশ আলাপ করাতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘‘এ হল কানন, তারকা অভিনেত্রী।’’ কানন প্রণাম করতেই রবীন্দ্রনাথ ওঁর ঠোঁট ছুয়ে বলেছিলেন, ‘‘কী সুন্দর মুখ তোমার! গান করো?’’ কবির মনে ছিল না এই মেয়েটিই ‘মুক্তি’-তে ওঁর গান গেয়েছেন। প্রশান্তচন্দ্র তখন যোগ করলেন, ‘‘ও তো আপনার গান গেয়েই বিখ্যাত।’’ রবীন্দ্রনাথ তখন বলেছিলেন, ‘‘তাই? তা হলে একবার শান্তিনিকেতনে এসে গান শুনিয়ো আমাকে।’’ সেই সৌভাগ্য কাননের আর হয়নি।