ঘুরে-ট্যুরে

স্মৃতির পাতা থেকে সুন্দরী জোংরি

By admin

November 07, 2020

অপূর্ব মিত্র

প্রথম পর্ব

পূর্ব কথা —

“এমনি ক’রে ঘুরিব দূরে বাহিরে,আর তো গতি নাহি রে মোর নাহি রে।। “

কবিগুরুর উক্তি উদ্ধৃত করে অবসর জীবনের অখন্ড বেলায় পুরোনো স্মৃতি আওড়ানোই আমার একমাত্র সময় কাটানোর ও শান্তি খোঁজার উপায়। আজ পিছন ফিরে তাকালে মনে হয়, ‘উঠলো বাই তো কটক যাই’ – এ কথাটা অনেকের মত আমার ক্ষেত্রেও খুবই প্রকট ছিল। কলেজ পেড়িয়ে সেই চাকরি অন্বেষণের দিন থেকেই তার বহিঃপ্রকাশ। সেই রোগ মাথা চাড়া দিয়েছিল ব্যাঙ্কেও সমধর্মী কিছু সহকর্মী-বন্ধু পেয়ে। সেই সময় পোস্টিং অন্ধ্র ব্যাঙ্কের হাওড়া শাখায়। তখন ব্যাঙ্কের কাউন্টার খোলা থাকতো দুপুর দুটো পর্য্যন্ত। ফলত হাতে অনেকটা সময় থাকার কারণে গল্পগুজব, আড্ডা, খেলাধুলা, কারো পিছনে লাগা ইত্যাদি রুটিনের মধ্যেই পড়তো। আর আমাদের প্রায় প্রত্যেকেরই কম বেশি একটা সংস্কৃতিক বোধও ছিল। সেই সময় কম্পিউটার আমাদের দেশের অফিস কাছাড়িতে আসেনি বা মোবাইলের করাল গ্রাসে পড়েনি আপামর জনসাধারন। অফিসের নিত্য কাজকর্ম ম্যানুয়ালি। ফলে আমাদের মধ্যে হৃদ্যতা ছিল অনেক গভীর ও জীবন ছিল প্রাণবন্ত। এরকমই এক দিনে অফিস এসেই সহকর্মী সমীর মুখার্জীর ঘোষণা “জোংরি যাব”। ওর পাড়া থেকে কে বা কারা জোংরি গেছে, ব্যাস ওকেও যেতেই হবে। আমরা তো আর ওকে একা যেতে দিতে পারিনা, দায়িত্ব ও কর্তব্যের খাতিরে তাই একে একে তিনজন ওর প্রস্তাবে হাত তুলে দিলাম। আমরা বলতে তাপস দাসগুপ্ত, মহম্মদ ফজল রসুল, আর আমি অপূর্ব মিত্র। যদিও আমরা কখনো নিজের ফূর্তির জন্য একেবারেই চিন্তা করতাম না। কিন্তু একেবারে অফিস ফাঁকা করে সবাইকে নিয়ে যাবার বিপক্ষেই ছিলাম। নতুবা আরও অনেকেই আগ্রহী ছিল। কিন্তু বিবেকের ডাকে সারা দিয়ে অফিস তথা কাস্টমার সার্ভিসের কথা চিন্তা করে কয়েকজন রয়ে গেল। তবে খিদিরপুর শাখা থেকে পঞ্চম সংযোজন হল শুভাশিষ বাসু।

সুলুক সন্ধান —জোংরি…জোংরি। সে খায় না মাথায় দেয় এসম্বন্ধে কোন ধারণাই ছিল না, কারন সমস্ত বিষয়েই আমার পাণ্ডিত্য ছিল বিশাল ও ধরাছোঁয়ার বাইরে। জানলাম, জোংরি হল পশ্চিম সিকিমে কাঞ্চনজঙ্ঘার পাদদেশ। ট্রেকিং করে যেতে হবে। পদে পদে নাকি রোমাঞ্চ। পাঁচ জনের দলের সর্বাধিনায়ক সমীর মুখার্জী। অবশ্য পোস্ট ওই একটাই। প্ল্যান করা থেকে খরচ খরচার হিসাব রাখা, সব দায়িত্ব ওর। আমরা শুধু অনুগ্রহপূর্বক ওকে সঙ্গ দিচ্ছিলাম মাত্র! সেই সময় অফিসে মাঝে মাঝে গান ধরতাম “হাত ধরে তুমি নিয়ে চলো সখা / আমি যে পথ চিনি—–নাআআআআ”। যাই হোক, ক্যাপ্টেনই সব খোঁজ খবর করতে শুরু করে দিলো। তখন আমাদের মধ্যে ওর কাছেই সম্ভবত ভ্রমনসঙ্গী বইটা ছিল। কিন্তু শুধু মাত্র ভ্রমনসঙ্গীর উপর ভরসা করে তো আর ট্রেকিং করা যায় না। সুতরাং ওকে আরও খাটা খাটনি করতে হয়েছিল তথ্য জোগাড় করতে। আমরাও একটু একটু করে জানতে লাগলাম, আর যে যেমন পারি খোঁজ খবর নিতে শুরু করলাম। তখন মোবাইল ফোনের নামই আমরা শুনিনি আর নেট বলতে মাছ ধরার জাল-ই বুঝতাম। সুতরাং এর-ওর কাছ থেকে তথ্য জোগাড় করতাম হয় হেঁটে না হলে সাইকেলে। আমিও তথ্যের সন্ধানে চন্দননগরের বাগবাজার নিবাসী দীপুদার কাছে হানা দিলাম একাধিক বার। তখন ট্রেকিং-এর ব্যাপারে দীপুদার চন্দননগরে বেশ নাম ডাক। তাই দীপুদাই ছিল আমার ভরসা আর অনুপ্রেরণা। যতই যাবার দিন কাছাকাছি আসছিল, ততই আমি একটা অদ্ভুত শিহরণ অনুভব করছিলাম। ইতিপুর্বে আমার ট্রেকিং এর অভিজ্ঞতা বলতে, টর্চ এর আলোয় হাতড়ে হাতড়ে গোমুখের লালবাবা আশ্রমে পৌঁছানো। সে যাত্রায় সঙ্গী ছিল আমার চন্দননগরের বিশেষ বন্ধু পার্থ দে । সুতরাং আমার আগ্রহ ছিল ষোলআনা।

লট বহর —

অনেক তথ্য জোগাড় হল – আনুমানিক খরচ খরচার হিসাব হল – কি করব, কি করব না তার তালিকা হল – কার কি লাগবে, কি কি নিতে হবে, আর কি কি জিনিস কিনতে হবে, এসব নিয়ে প্রায় রোজই নিজেদের মধ্যে মিটিং লেগেই থাকত। আর রোজকার আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল একই। তার জন্য যে আমরা একঘেয়েমি অনুভব করতাম তা নয়। এবার আমাদের ব্যক্তিগত জিনিসপত্র যেমন হান্টার সু, রুকস্যাক, রেইনকোট, সানগ্লাস ইত্যাদি জোগাড় করার পালা। আমার মনে আছে ফজল আর শুভাশিষের জন্য রুকস্যাকটা আমরা চন্দননগরের গিরিদূত ক্লাব থেকে ভাড়ার বিনিময়ে জোগাড় করেছিলাম এবং শর্ত ছিল, একটা ফুটো হলে ফাইন পঞ্চাশ টাকা। এই নিয়ে আমাদের মধ্যে হাসাহাসিও নেহাৎ কম হয়নি।এর মধ্যে প্রতিদিনের জন্য মাথাপিছু হিসাব করে রেশন অর্থাৎ চাল, ডাল, সর্ষের তেল, মশলাপাতি, আদা, রসুন, পিঁয়াজ, লবন আর ড্রাইফুডের মধ্যে ছাতু, খেজুর, আমসত্ত্ব, লজেন্স কিনে নেওয়া হল – হাঁটতে গেলে শরীরটা তো রাখতে হবে। ছাতু বাদে বাকি ড্রাই ফুডগুলো প্রত্যেকের আলাদা আলাদা ভাবে প্যাকেট করা হয়েছিল যাতে যে যার নিজের ব্যাগে বইতে পারে। এছাড়া প্রত্যেকের খাবার প্লেট, গ্লাস, রান্নার বাসনপত্র, জনতা স্টোভ, পাম্প স্টোভ, কেরোসিন তেল – সব বস্তায় দড়ি বেঁধে নিয়ে নিলাম। আর নিলাম দোক্তাপাতা – জোঁকের সঙ্গে মোকাবিলা করার জন্য।সবার মধ্যেই একটা চাপা উত্তেজনা। একদিন কথা প্রসঙ্গে শুভাশিষ বলেই ফেললো যে ওর ছোট মামা শিলিগুড়িতে থাকেন। ব্যাস আর যাবে কোথায়। ওর ছোটমামা মানে আমাদেরও ছোট মামা। আমাদের আর অন্য জায়গায় ওঠার প্রশ্নই উঠে না, পাছে পরে শুনতে পেয়ে ছোটমামা কষ্ট পায় বা রাগ করে সেটা মেটেই আমাদের কাম্য নয়। সুতরাং শিলিগুড়িতে থাকা খাওয়ার চিন্তা দূর হলো। আমরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।

যাত্রা শুরু —দিনটা ছিল ১৯৯০ সালের ৬ই অক্টোবর, শনিবার। কোনো রকম ক্লোজিং এর সময়ও ওটা ছিল না। ফলে আমাদের ছুটি পাওয়া নিয়ে বিশেষ কোনো অসুবিধা হয়নি। আর তখন অফিসগুলোতে পর্য্যাপ্ত কর্মচারীও থাকতো। রকেট-বাসটা এসপ্ল্যানেড থেকে প্রায় বিকাল পাঁচটার সময় ছাড়ল। গন্তব্য শিলিগুড়ি। আমাদের সিটগুলো ছিল বাসের প্রায় পিছন দিকে। রাতে রকেট-বাসে ভ্রমণের মজাই আলাদা। চেয়ারগুলো বেশ কিছুটা আধশোয়া হবার উপযোগী করে হেলানো যেত। খানিকক্ষন চলার পর রাত ন’টা নাগাদ বাসের মধ্যে ক্ষীণ নীল আলো জ্বলে উঠল। আমরাও গল্প করতে করতে মাঝে মাঝেই ঢুলতে লাগলাম। বাসটা প্রথম থেমেছিল কৃষ্ণনগর পৌঁছে। চা, টিফিন, খাবার অথবা টয়লেট যার যেমন দরকার মিটিয়ে নেবার সময়। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর হর্ন বাজিয়ে সব্বাইকে ডেকে তুলে এবং কন্ডাকটারের কাছ থেকে যাত্রীসংখ্যা কনফার্ম করে নিয়ে আবার চলা। দূরপাল্লার বাসগুলো মোটামুটি সব একসঙ্গেই যেতো সামনে-পিছনে পুলিশের গাড়ি পাহারায়। কারণ সেইসময় প্রায়শই পথে বাস ডাকাতির খবর পাওয়া যেত। কৃষ্ণনগর থেকে ছেড়ে মাঝরাতে একবার ঘুম ভাঙলে দেখলাম বাস মালদায় দাঁড়িয়েছে। তারপর আর মনে নেই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাম। ঘুম ভাঙল যখন দেখি বাস শিলিগুড়ির তেনজিং নোরগে বাস টার্মিনাসে দাঁড়িয়েছে। ছোট মামার বাড়ি যদিও বাস স্ট্যান্ড থেকে খুব দূরে নয় কিন্তু আমাদের কাছে অনেক লাগেজ ছিল বলে সাইকেল রিক্সা করতেই হল। ছোট মামা ও মামী এতগুলো ভাগ্নে পেয়ে কি ভাবে আপ্যায়ন করবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। বাজার থেকে নানা ধরণের মাছ এনে আমাদের ভুরিভোজের ব্যবস্থা করেছিলেন। ছোট মামা ও মামী দুইজনই খুব হাসি-খুশি, একদম আমাদের মনের মতো। মামার বাড়ির পাতকুয়োর জলে স্নান করে নানা পদের মাছ সহযোগে না—আ, আর না—-আ করে মধ্যাহ্ন ভোজ পর্ব সারলাম। মাম-মামীর আতিথ্য নিতে আমাদের কোনো অসুবিধাই হয়নি। যাই হোক, তাঁদেরকে প্রণাম জানিয়ে আবার ফেরার পথে দুই দিন ওখানে থেকে যাবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে শেয়ার জিপে জোড়থাং এর দিকে রওনা দিলাম। তখন ঘড়িতে প্রায় একটা বাজে।

শেয়ার জিপে সুন্দর পাহাড়ী পথ পাড়ি দিয়ে যখন পশ্চিম সিকিমের জোড়থাং পৌঁছালাম, তখন বিকাল সাড়ে-চারটে হবে। খুব সুন্দর, ছবির মতো শহর। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা প্রায় ১০৬০ ফিট। ছোট শহরের কারণে পায়ে পায়েই ঘুরে নেয়া যায়। ছোট একটি পাহাড়ি নদীও আছে, আর আছে আমাদের দ্বিতীয় হুগলি সেতুর মিনিয়েচার – ছোট একটা ব্রিজ। তার ওপরটা দার্জিলিং আর এপারটা সিকিম। ফুটবল খেলার মাঠও চোখে পড়ল একটা। দোকানে মদ বিক্রী হচ্ছে দেখে কেউ একজন দাম যাচাইও করে এসে বলল – বেশ সস্তা। আমরা খুব কম ভাড়ার বেশ ভালো হোটেলেই ছিলাম। কিন্তু আরো কিছু সুন্দর হোটেল মনে ধরেছিল, যেগুলির ঘর গুলো ছিল গ্রাউন্ড ফ্লোরে আর টয়লেটটা ছিল তার দশ ফুট উপরে, আর রুম থেকে একটু দূরে। নড়বড়ে পাথরের তৈরী আর জল অফুরন্ত। তবে কিনা সেই জল আনতে হতো আরও নীচে জোড়থাং নদী থেকে। এখানে চুপি চুপি একটা কথা বলে রাখি আমার স্নান কিন্ত এখন থেকেই বন্ধ। পরের দিন আমাদের গন্তব্য ইয়কসাম ভায়া গেজিং। তার জন্য বিকালে মিনিবাসে সিট বুক করতে হল। সকাল ছ’টার বাস। ছটা মানে ছ’টা, ছ’টা বেজে এক নয়।

চলবে..