এক নজরে

#SpecialReport : শিকারি হলেও করবেট বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের গুরুত্ব বুঝতেন

By admin

June 25, 2022

তখন ভারত জুড়ে শিকারের রীতি জনপ্রিয়। তার সঙ্গে জড়িত ব্রিটিশ সাহেব এবং দেশের বিভিন্ন রাজপরিবার। শিকার অভিযান তখন মহাসমারোহে একরকম আভিজাত্যেরই প্রতীক।তবে তিনি শিকার করতেন সম্পূর্ণ আলাদা কারণে। জীবদ্দশায় যে কটি প্রাণীর শিকার করেছিলেন, তার সবকটিই ছিল মানুষখেকো। এক কথায় জনস্বার্থেই যেন বন্দুক তুলে নিয়েছিলেন তিনি। আর সেই কারণেই কুমায়ূনের স্থানীয় মানুষদের কাছে তিনি ঈশ্বর হয়ে উঠেছিলেন। বাঘকে ‘নিষ্ঠুর হত্যাকারী’ বলতে তাঁর ঘোরতর আপত্তি ছিল। নিজের লেখাতে একাধিকবার লিখেছেন, বয়ঃবৃদ্ধির কারণে শিকারে ক্ষমতা লোপ পেলে বাঘ মানুষ খেকো হয়ে ওঠে। আর সেই কারণেই ব্যাঘ্রহত্যা।

কিন্তু মানুষের প্রাণ বাঁচাতে ব্যাঘ্রহত্যা কতটা যুক্তিযুক্ত? পরবর্তীতে ভারতের পরিবেশবিদরা তা নিয়ে সরব হয়েছেন। যাকে বলা হত চম্পাবতের বাঘিনী, সে নেপালে প্রায় দুশো মানুষ মেরেছিল। সশস্ত্র নেপালীদের তাড়ায় সে কুমায়ুনে এসে আশ্রয় নেয় এবং চার বছরে কুমায়ুনে আরও দুশো চৌত্রিশ জনকে হত্যা করে। নৈনিতালের কমিশনারের অনুরোধে জিম করবেট বাঘিনীটিকে মারতে সম্মত হয়ে প্রায় পাঁচদিন পর উপস্থিত হন, উত্তরাখন্ডের পালিগ্রামে। উদ্দেশ্য মানুষখেকোর ভবলীলা সাঙ্গ করা। কলাধুঙ্গির বন্য পরিবেশে বড়ো হয়ে ওঠা করবেট খুব অল্প বয়সেই বন আর বন্য প্রকৃতি সম্পর্কে অনেক কিছু শিখে ফেলেছিলেন। হুবহু নকল করতেন পশুপাখিদের ডাক। জীবিকার প্রয়োজনে ফুয়েল ইন্সপেক্টর হিসেবে বেঙ্গল ও নর্থ ওয়েস্টার্ন রেলওয়েতে যোগদান করে তিনি অর্থোপার্জনে নেমে পড়েন। ১৯১১ থেকে ১৯৩৮- এই ২৭ বছরে মোট এক ডজন মানুষখেকো বাঘ শিকার করেন। ওই এক ডজন বাঘ ২৭ বছরে প্রায় দেড় হাজার মানুষের প্রাণ নিয়েছিল। কিন্তু সবসময়ই চম্পাবতের মানুষখেকো বাঘ ছিল তাঁর প্রথম শিকার। ৪৩৪ জনকে মেরে ফেলা সেই বাঘ যে একটি হৃষ্টপুষ্ট বাঘিনী করবেট তার সুদক্ষ তদন্তশক্তির মাধ্যমে বুঝতে পারেন। বাঘিনীটির জন্ম নেপালে এবং সেখানে প্রায় ২০০ জন মানুষকে হত্যা করে নেপালী আর্মির তাড়া খেয়ে সে ভারতে চলে আসতে বাধ্য হয়।

জিম করবেটের (jim corbett) মানুষখেকো চিতা বাঘ শিকারে হাতেখড়ি হয় আলমোড়ায়। আলমোড়ার পানার অঞ্চলে একটি চিতা প্রায় ৮০০ জনের ওপর মানুষকে খতম করে ত্রাস সৃষ্টি করেছিল। অন্যদিকে কুমায়ুনের বাঘটি গ্রাম উজাড় করে দিচ্ছিল। কেদারনাথ ও বদ্রীনাথে ৮ বছরে মোট ৩৩ টি বাঘ ও চিতা নিধন করে তিনি প্রভূত জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। তার লেখা ম্যান ইটার্স অব কুমায়ুন ভারত, ইংল্যান্ড ও আমেরিকায় ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা পায় এবং ২৭ টিরও অধিক ভাষায় অনূদিত হয়। করবেটের অন্যান্য বিখ্যাত শিকারনামার ভেতরে টাইগার্স অব চৌগড়, দ্য মুক্তেশ্বর ম্যান ইটার, তল্লাদেশ ম্যান ইটার, দ্য থাক ম্যান ইটার এবং দ্য মোহন ম্যান ইটার বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁর বন্দুক অব্যর্থ নিশানায় গর্জে উঠত মানুষখেকো বাঘ বা চিতা দেখলেই। তবে জিম করবেটের সহায়তাতেই ১৯৩৬ সালে নির্মিত হয়েছিল নৈনিতালের দ্য হেইলি ন্যাশানাল পার্ক। এই জাতীয় উদ্যানটি এশিয়ার প্রথম ন্যাশনাল পার্ক। এই জাতীয় উদ্যানটির নাম ১৯৫৬-তে রাখা হয় জিম করবেট ন্যাশনাল পার্ক

জিমকে অনেকেই ‘মানবতাবাদী শিকারি’ বলেন। কারণ, শিকারি হওয়া সত্ত্বেও করবেট মনেপ্রাণে ছিলেন একজন পশুপ্রেমী। জিম করবেটকে পাহাড়ি মানুষজন ডাকত ‘কার্পেট সাহেব’ বলে। জিম শিকার করলেও বুঝতেন বন্যপ্রাণী  সংরক্ষণের গুরুত্ব। বুঝেছিলেন বন এবং বন্যপ্রাণকে বাঁচাতে হবে। প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় বন্যপ্রাণীর গুরুত্ব অপরিসীম। এই বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে তিনি বহুজায়গায় বক্তৃতা দিতে যেতেন। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কিম্বা গ্রামের উৎসব অনুষ্ঠান শিকারের বিচিত্র গল্প শোনাতেন আর বলতেন বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের কথা। ব্যক্তিগতভাবে রাজাদের অনুরোধ করেন, তারা যেন অকারণে শিকার না করেন।তার মতে শিকার তখনই মান্যতা পায় যখন তা হয় সাধারণ নিরীহ মানু‌ষের প্রাণ রক্ষার স্বার্থে। জিম বলতেন, সুস্থ বাঘেরা সবসময়েই মানুষের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলে। তাদের খাদ্যাভ্যাসের মধ্যেও মানুষের মাংসের প্রতি আগ্রহ লক্ষ্য করা যায় না। তারা মূলত মানুষখেকো হয়ে ওঠে বয়সের ভারে শিকার করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেললে। কিন্তু চম্পাবতের বাঘিনীর মতো আরও অনেক বাঘ তাদের বাস্তুতন্ত্রের ওপর শতাব্দীর পর শতাব্দী ধ্বংসযজ্ঞের ফলে মানুষখেকো হয়ে উঠতে পারে।

পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১৮৭৫ থেকে ১৯২৫- ৮০ হাজার বাঘ কেবল শিকারের উদ্দেশ্যেই হত্যা হয়েছে। বিগত শতাব্দীর মধ্যেই দেশের ৬৭% এলাকা থেকেবাঘ নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল।ভারতবর্ষে বাঘেদের জন্যজিম করবেট সারা জীবন কাজ করে গেছেন অভয়াশ্রম তৈরির উদ্দেশ্যে। ১৯৩৮ সালের ৩০ নভেম্বর সন্ধ্যা ৬ টায় থাক-এর মানুষখেকো বাঘিনী শিকারের পর জিম করবেট তাঁর শিকারি জীবনের ইতি টেনেছিলেন। এরপর তিনি চলে যাননাইরোবি। পরে আস্তানা গাড়েন নিয়েরে। সেখানে লেখালেখির মধ্য দিয়েই দিন কাটতে লাগল করবেটের। হঠাৎ একদিন গুলির শব্দ শুনে জিমের শিকারি মন চঞ্চল হয়ে উঠল। আফ্রিকার জঙ্গলে  গুলিগোলার শব্দ শুনে নিজেকে আর স্থির রাখতে পারলেন। ছুটে গেলেন জঙ্গলে আর গিয়ে যখন দেখলেন নির্বিচারে পশুহত্যা চলছে তখন জিমকে বিচলিত করে তুলল। কেনিয়ায় নির্মম পশুহত্যা রুখতে ‘বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ’ আন্দোলন শুরু করলেন জিম। বহুমানুষ তাতে সামিল হল। তার নেতৃত্বে বন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আন্দোলন সারা আফ্রিকা জুড়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে।