ঘুরে-ট্যুরে

একদিনের ঝড়খালি ভ্রমণ

By admin

December 14, 2020

বেরিয়ে পড়াটা নেশা। আর এই নেশাটা বোধ হয় মানুষের যাযাবর বৃত্তির সঙ্গে ওতপ্রোতাবে জড়িত। এককালে তো মানুষ যাযাবরই ছিল। এক জায়গায় মন টেঁকে না। আর কলকাতা শহরে তো নয়ই। আপনি চেন্নাই, দিল্লি বা ভুবনেশ্বর যেখানেই যান গাড়ি নিয়ে শহর ছড়িয়ে একটু এগিয়ে গেলেই সবুজের সমারোহ। কলকাতা ছড়িয়ে এগিয়ে যান। দেখবেন বাড়ি আর বাড়ি। এখন তো সবই মালটিষ্টরিড বিল্ডিং। গগনচুম্বী। আকাশ ছুঁতে চাইছে মানুষ। না সবুজ কোত্থাও নেই। নীল সাদা বাতি আছে, সুন্দর মূর্তি আছে, পাঁচতারা, তিনতারা হোটেল আছে, বাবুদের রসসাদনের স্বাদের রিসর্ট আছে। কিন্তু সবুজের স্থান নেই। পাখি , গাছ, অরণ্য, প্রকৃতি নিয়ে মানুষের ভাবার সময় নেই।

আছে গুটি কয় আমার মত । হেদিয়ে মরে, চেঁচিয়ে মরে। কে কার কথা শোনে ? খাল , বিল জলাশয় সব বুজিয়ে বাড়ি তোল। সিন্ডিকেট রাজ চালিয়ে যাও। টাকা চাই , টাকা। তাই বেরিয়ে পড়ি । শরীরের পরিচর্যার মতো মনের পরিচর্যা বলে একটা কথা আছে। এবারে কভিড বড়ো বাঁধা। না পারলাম গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে একটু বাড় হতে, না পারলাম পুজোয়। তাই শীত পড়তে মনটা আবার যাযাবর হয়ে গেলো। এক বন্ধু খবর দিল ঝড় খালি ঘুরে আয় ভালো লাগবে। যেমন যেমন দিকনির্দেশ দিল সেই মতো চললাম গাড়ি করে। সঙ্গী আমার ছেলে। তার ও ঘুরতে যাবার বেশ নেশা। পড়াশোনাটা অন্তত একদিন করতে হবে না।

গাড়ি নিয়ে সাইন্স সিটি পেরিয়ে বান তলা হাইওয়ে। খানিকটা পেরিয়ে গেলে ভেরি পড়বে একটার পর একটা। গাছপালা উঁকি ঝুঁকি দেবে। মনে হবে কলকাতার কংক্রিট থেকে একটু যেনো বেরোতে পেরেছেন। ভ্যান গাড়ি তে মোটর লাগিয়ে সবজি চলেছে কলকাতার দিকে। সকাল তখন উঁকি মারছে। গাড়ির কাঁচটা নামাতেই একটা হওয়ার ঝাপ্টা। সকালের একটু অক্সিজেন পাবেন। আরো একটু এগিয়ে গেলো গাড়ি। হাঁস, মুরগি ঘুরছে। এই বাড়ি ওই বাড়ি মানুষ বেরোচ্ছে। মুখে মাস্ক । কারো আবার ওসবের বালাই নেই। দিব্যি হেলতে দুলতে চলেছে সাইকেল চালিয়ে। যদি শহুরে বাবু বা বিবি হন এই সব ভালো লাগবে না। মনে হবে সুইমিং পুলের ধরে জাঙ্গিয়া আর টু পিস পড়ে বিয়ারে চুমুক দিলে দিনটা ভালো যেত। বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ এটা। আপনাদের না যাওয়া ই ভালো।

আর একটু এগিয়ে চলুন বাঁধা কপি বেঁধে ভ্যান চলেছে শহরে । দেখবার মত বই কি। দেখার চোখ থাকতে হবে। সে কি আর একটা ভ্যান। ভানের পর ভ্যান। গ্রামের টাটকা তাজা বলেই তো মনে হচ্ছে। আজকাল অবশ্য সভ্যতা তাদের রাসায়নিক সার মেশানো শিখিয়ে দিয়েছে। সভ্যতার খিদে অনেক। পয়দা করো আর গেলাও। কি খাওয়াচ্ছে সে দেখার দরকার নেই। খেয়ে কি হবে? কোন বিষ় শরীরে ঢুকবে ? সে সব গৌণ। মানুষকে খাওয়াতে হবে যাতে সে বাঁচতে পারে । নইলে বাবুদের কাজ করে দেবার লোক পাওয়া যাবে না। ডেলিভারি বয়, মিস্ত্রি এদের জন্য রাসায়নিক সার মিশ্রিত খবর। বাবুরা বিবিরা খাবেন অর্গানিক ফুড। বাহ রে সভ্যতা। গাড়ি আরও এগিয়ে গেলে ধানক্ষেত নজর কাড়বে। চাষীরা কাজ করছেন। ছোটো ছোটো কুঁড়ে ঘর। ধানের গোলা। মনটা ভরে যাবে। কোথাও দেখবেন ছোটো ছোটো ছেলেরা একটা সাইকেলের টায়ার নিয়ে খেলা করছে। গরীব মানুষ। মোবাইলই নেই তো গেম। পাখির ডাক কানে আসছে। দোয়েল, টিয়া, বাশপতি, কোকিল, রমগাংরা, ভিমরাজ আরও কত পাখি। ”

একটু দাড়ান তো” ড্রাইভার কে বললাম। মনটা চা চা করছিল। গাড়ি দাড়ালো। গলা ভেজাল। একটা সিগারেট ধরালাম। দেখি একটা দশ বারো বছরের ছেলে হাতে দুটো কুড়ি টাকার নোট নিয়ে আসছে। ” তোর নাম কি রে ? কি করিস ? ” “ওই যে ভেরিটা দেখছো। ওখানে কাজ করি।” মুখময় কাদা। কাজ করে চল্লিশ টাকা রোজগার হয়েছে। তাই নিয়ে বাড়ি ফিরছে। নাম পেল্লাদ। রাজনৈতিক নেতাদের রাম রাজত্ব এসে গেলো বলে। আর একদল বলছে উন্নয়ন হয়েছে। হচ্ছে। এই আমার বাংলা। “বঙ্গ আমার জননী আমার বঙ্গ আমার আমার দেশ / কেনো গো মা তোর শুষ্ক নয়ন, কেনো গো মা তোর শুষ্ক কেশ। “

এগিয়ে গেলে হাট বসেছে গ্রামের রাস্তায়। মাছ, মুরগি, কাঁকড়া, সবজি, অনাজপাতি বিক্রি হচ্ছে। কোথাও আবার আপেল, কমলা লেবু , সবেদা। একটু এগিয়ে যেতে সর্বেরিয়া মোড়ে একটা হোটেল পড়লো । খেয়ে নিয়ে আবার যাত্রা। এখনো ৫০ কিমি ঝড় খালি। মাঝে পড়লো ক্যানিং ব্রিজ। সেখান থেকে মাতলা নদী দেখা এক অনন্য অভিজ্ঞতা। নৌকা যাচ্ছে মাতলা দিয়ে। লঞ্চ দাড়িয়ে আছে। মাঝি মাল্লারা রান্না করছে। রাস্তা হারিয়ে গুগোল ম্যাপ খুলে কখন যে ঝরখালির রাস্তা পেরিয়ে এসেছি খেয়াল নেই। একজন বললো একটু গেলেই গদখালী। দেখেই যাই তবে। গদখালী থেকে লঞ্চ ছাড়ছে। ওপারে গোসাবা।ডিম , ছোটো মুরগি আসছে দেখলাম গোসাবা থেকে। কলকাতায় চালান হবে।

লঞ্চ থেকে বহু লোক নেমে কলকাতার আর বারুইপুরের বাস ধরছেন। নদীর কাছেই এক মাঝি বসেছিলেন। ২৫০ – ৩০০ টাকায় একঘন্টা নদী ঘোরাবেন। না সময় নেই আজ। গদখালী অন্য কোনো দিন আসা যাবে । আজ ঝড় খালি। আবার যাত্রা শুরু। ঝড়খালি আর ৮ – ১০ কিমি। এসে পৌঁছলাম দুপুর বেলা। ঝড় খালিতে একটা ন্যাচর ক্যাম্প আছে। ঘুরে দেখলাম। ভেতরে দুটো বাঘ আছে। তাদের গর্জন কানে এলো বটে। দেখা মিলল না। কিছু কুমির আছে। ঘুরে দেখতে মন্দ লাগবে না। অসংখ্য প্রজাপতি আর পাখি। সুয্যি তখন ডুবুডুবু।

ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে নদীর ঘাটে এলাম। প্রচুর দোকান, পসরা সাজিয়ে বসেছে। ডাব, চা, ডিম, সুন্দরবনের মধু বিক্রি হচ্ছে। চা আর টোস্ট খেলাম। আম্ফানে অনেক ক্ষতি হয়েছে এখানে। দোকানির সঙ্গে গল্প হলো। তারপর নদীর ধার। কত যে সুন্দরী আর গরান গাছ কি আর বলবো। নদী দিগন্তবিস্তৃত। জেলে নৌকা চলেছে। লঞ্চ দাড়িয়ে আছে। সূর্য অস্ত গেলো। সেও এক অনন্য অভিজ্ঞতা। সারা আকাশ লাল। নদীতে ছায়া পড়েছে অস্তমিত সূর্যের। ফিরে এলাম কলকাতা।