ঘুরে-ট্যুরে

পর্যটনে ঝাড়গ্রাম

By admin

September 05, 2020

(দ্বিতীয় পর্ব)

এর পরদিন আমরা সকাল সকাল ঝাড়গ্রাম থেকে বেরিয়ে পড়বো। প্রথমেই ঢুঁ মারবো শিলদা রাজবাড়িতে। ঝাড়গ্রাম থেকে শিলদার দূরত্ব ৩০ কিলোমিটার। রাজা মানগোবিন্দ মল্লদেব এবং রাণী কিশোরমনির স্মৃতিবিজড়িত এই গড়বাড়ি। রাজবাড়িটি উঁচু ঢিবির মত হয়ে গেছে। তোরণটি শুধু টিকে আছে। রানী কিশোরমনির প্রতিষ্ঠিত রাধাকৃষ্ণের মন্দিরটি এখনো আছে। মাকরা পাথরের তৈরি মন্দির, বিগ্রহ পিতলের। মানগোবিন্দের প্রপিতামহ দক্ষিণ দেশ থেকে এসে তৎকালীন রাজা বিজয় সিংহকে পরাজিত করে শিলদা পরগনা দখল করেন। শিলদা পরগনার পূর্বের নাম ছিল ঝাটিবনি। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দশসালা বন্দোবস্ত অনুযায়ী শিলদা পরগনার জমিদার ছিলেন মানগোবিন্দ। মানগোবিন্দের ছিল সাত রানী। তার মৃত্যুর পর ১৮০৬ সালে তার অন্যতম স্ত্রী কিশোরমনি রাজ্যভার গ্রহণ করেন।

শিলদা থেকে ডানদিকে বাঁকুড়া যাওয়ার রাস্তায় দু কিলোমিটার গেলে ওরগোঁদা। ফাঁকা মাঠের মধ্যে দুটি পাথরের মাকড়া পাথরের উঁচু বেদি। একটি ভৈরব থান এবং অন্যটি রঙ্কিনী দেবীর থান। ভৈরব থানটি মাটির হাতি ঘোড়া দ্বারা পরিবৃত। মনে হয় এখানে আগে পাথরের মন্দির ছিল বর্তমানে শুধু ভিত অবশিষ্ট আছে। দেখে মনে হবে, আমরা যেন ইনকা সভ্যতার দেশে চলে এসেছি। এখানে দুর্গাপূজার সময় দশমীর দিন এবং তারপর দিন, পরপর দুদিন পাতাবেদাঁ পরব উপলক্ষে বিরাট মেলা বসে। প্রথম দিন সব শ্রেণীর মানুষদের জন্য এবং দ্বিতীয় দিন কেবলমাত্র আদিবাসীদের জন্য। এই মেলা জঙ্গলমহলের অন্যতম জনবহুল মেলা।

আমরা শিলদা থেকে বাম দিকের রাস্তা ধরে এগিয়ে যাব বেলপাহাড়ির দিকে। শিলদা থেকে বেলপাহাড়ি মাত্র ৮ কিমি। বেলপাহাড়ি নাম শুনলেই শিহরণ জাগে। সদর বেলপাহাড়িতে কোন পাহাড় নেই। এটা একটা গঞ্জ। বিনপুর-২ বিডিও অফিস, থানা, ফরেস্ট অফিস, বাজার-হাট সবমিলিয়ে জমজমাট। একটি সুন্দর ফরেস্ট বাংলোও আছে। পঞ্চায়েত সমিতির অফিসে গেস্টহাউস আছে। এসব দেখে আর ভয় করবে না। বেলপাহাড়ি থানার পেছন দিকে আছে নীলকুঠির ধ্বংসাবশেষ। নীল যে তৈরি হতো তা পরিকাঠামো দেখলে বোঝা যায়। আর বেলপাহাড়ি থানা মাওবাদী আন্দোলনের বহু ঘটনার সাক্ষী। এসব দেখে যদি সময় নষ্ট করতে না চান, তবে একটু জিরিয়ে নেবার জন্য গাড়ি থামিয়ে চা খেয়ে নিতে পারেন।

বেলপাহাড়ি থেকে ডান দিকে সোজা সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার দূরে ঘাগড়া প্রকৃতি পর্যটন কেন্দ্র। এখানে তারাফেনী নদীর জলপ্রবাহ শিলার ওপর ক্ষয়কার্য করে বেশ বড় বড় গর্ত সৃষ্টি করেছে। বর্ষাকাল ছাড়া অন্য সময় তারাফেনীর সংকীর্ণ ধারার পাশে, পাথরের বুকে এই অপরূপ সৌন্দর্য সবাইকে অবাক করবে।ঘাগড়া থেকে আমরা আবার ফিরবো বেলপাহাড়ি। এবার এখান থেকে বাম দিকে আগুইবিলের দিকে ৯ কিলোমিটার দূরে গাড়রাসিনি পাহাড়। ১৭৫ মিটার উঁচুতে ওঠার জন্য পাথুরে পথ আছে। একেবারে চূড়ায় আছে শিবমন্দির। কেউ চাইলে উঠে একটু গায়ের ঘাম ঝরাতে পারেন। নিচে আছে আচার্য সত্যানন্দ আশ্রম।

এখান থেকে আমরা চলে যাব খাঁদারানি ড্যাম। গাড়রাসিনি থেকে জঙ্গল পথে খাঁদারানি মাত্র আড়াই কিমি। খাঁদারানি বাঁধের ভরা জল দেখে আপনার মন ভরে যাবে। মনে হবে কে যে এর নাম খাঁদারানি রাখল? এতো বেলপাহাড়ির রানি। সবুজ পাহাড় ঘেরা সবুজ-নীল জল দেখে মন বলবে, এখানেই শেষ করি ঝাড়গ্রাম ভ্রমণ।খাঁদারানীর মোহ কাটিয়ে আমাদের যেতে হবে লালজল। বেলপাহাড়ি থেকে বাঁশপাহাড়ি যাওয়ার রাস্তায় জামতলাগোড়া পেরিয়ে লালজল মোড় থেকে দু’কিলোমিটার ভিতরে লালজল গ্রাম। খাঁদারানি থেকে দূরত্ব ১৩ কিলোমিটার। দেব পাহাড় এবং সিংলহর পাহাড় দিয়ে ঘেরা এই গ্রাম। দেব পাহাড়ের উপর একটি বড় প্রাকৃতিক গুহা আছে। সামান্য পরিশ্রম করে যদি গুহামুখে যাওয়া যায়, তখন মনে হবে, ‘আমি এলেম কোন আদিম দেশে’। অনেকে বলেন এখানে আগে লাল জলের ঝর্ণা ছিল তাই এই এরকম নামকরণ।

লালজল ত্যাগ করে আমরা এগিয়ে যাব বাঁশপাহাড়ির দিকে। কিছুক্ষণ বাদে পড়বে সিয়ারবিন্দা চড়াই। আগে এখানে গাড়ি নিয়ে যাওয়ার সময় গাড়ি থেকে নেমে যেতে হতো সবাইকে। এতটা খাড়াই ছিল রাস্তা। বর্তমানে বেশ মসৃণ রাস্তা। তবে চড়াইয়ের আমেজটা এখনো আছে। দু’পাশে মায়াবী জঙ্গল নেমে গেছে। জঙ্গলের নির্জনতা ভেঙে মাঝে মাঝে গাড়ি ছুটে যাচ্ছে। সিয়ারবিন্দা টপে গাড়ি দাঁড় করিয়ে, একটু নেমে দাঁড়ালে মনে হবে, লোকালয়ের কোলাহল ছেড়ে আজ আমি কত উঁচুতে।

এরপর আমাদের গন্তব্য কাঁকড়াঝোড়। এখন আপনাকে একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে কাঁকড়াঝোড় কোন পথে যাবেন? কাঁকড়াঝোড় যাবার দুটি পথ আছে। একটি ভুলাভেদা হয়ে সনাতনী টেকিং রুট। আগে এ পথ ছিল বড় বড় বোল্ডারের। এখন মোরামে রাঙ্গা। এখন থেকে কাঁকড়াঝোড় ১৬ কিলোমিটার। পথে পড়বে দলদলি। এখানে বাংলায় মাওবাদীরা প্রথম ল্যান্ড মাইন বিস্ফোরণ করেছিল। ২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। এই পথটি নির্ধারিত আছে ট্রেকিং এর জন্য। গাড়ি যায়, তবে যারা গাড়ি নিয়ে যাবেন তাদের আরেকটু এগিয়ে চাকাডোবা থেকে ডাইনে ঘুরে ছুরিমারা হয়ে কাঁকড়াঝোড় যাওয়াই ভালো। ছুরিমারাতে একটি পুলিশের ক্যাম্প আছে। ক্যাম্পে একটি পুলিশের পাঠশালা চলে। সকালে গেলে এটি দেখা যায়। বেলপাহাড়ি ভ্রমণে লক্ষ্য থাকে কাঁকড়াঝোড়-এ পদার্পণ। পদার্পণ না করলে এর মাহাত্ম্য বোঝা যাবে না। অদূরে নীলপাহাড়, সবুজ বনানী আর লাল কাঁকুড়ে মাটি। মনে হবে এখানে না এলে জীবন অপূর্ন থেকে যেত। কাছেই বিখ্যাত আমলাশোল গ্রাম। দু কিলোমিটার দূরে ময়ূর ঝরনা, আরো এক কিলোমিটার দূরে আম ঝরনা। ভাববেন না ঝরনা মানে ঝিরিঝিরি ঝরনা। ঝরনা মানে এখানে পুকুর। আম ঝরনা পেরিয়ে ত্রিসীমানা। এটি ঝাড়খন্ড, পুরুলিয়া ও ঝাড়গ্রামের বর্ডার। এখান থেকে ঝাড়খণ্ডের মধ্যে দিয়ে পুরুলিয়ার দুয়ারসিনি যাওয়া যায়। আগে কাঁকড়াঝোড়-এ ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট এবং ট্যুরিজম ডিপার্টমেন্টের দুটি বাংলো ছিল। ২০০৪ সালে ডিসেম্বর মাসে মাওবাদীরা এ’দুটি উড়িয়ে দেয়। বর্তমানে সেখানে সিআরপিএফ ক্যাম্প। এখন এখানে থাকতে চাইলে স্থানীয় কিছু বাড়িতে হোম স্টে -র ব্যবস্থা আছে। আমাদের যাত্রা এখানেই শেষ করতে পারি। যদি কেউ দীর্ঘায়িত করতে চান বা আরো বেশি গভীরে যাওয়ার আগ্রহ থাকে তবে আমরা যাব শিমুলপাল অঞ্চলে।

শিমুল পাল অঞ্চলে আমরা প্রথমে যাব ঢাঙ্গিকুসুম। পথে পড়বে কদমডিহা, বুড়িঝোড় ও চিড়াকুটি। কাঁকড়াঝোড় থেকে দূরত্ব ১৫ কিমি। চিড়াকুটি থেকে ডান দিকে মোড় নিতে হবে। গ্রামে যেতে গেলে পেরোতে হবে এক পাহাড় ভেদ করা রাস্তা। এ রাস্তায় যতবার যাবেন ততবার পুলকিত হবেন। দু’ধারে অনুচ্চ পাহাড়। পাহাড় কেটে যে পথ বার করা হয়েছে তার চিহ্ন প্রকট। পাহাড় পেরোলে মনে হবে, এখান থেকে সভ্যতা অনেক দূর। গ্রামে প্রবেশ করলে মনটা হয়ে যাবে ম্রিয়মাণ। খুব গরীব প্রত্যন্ত গ্রাম। যখন এই রাস্তা ছিলনা তখন অনেক কষ্ট করে এদের সদর বেলপাহাড়িতে যেতে হতো। এখানে কয়েক ঘর পাথর শিল্পীর বাস। সারাদিনে হয়তো একটা থালা তৈরি করে সপরিবারে। সেটা হয়তো বেলপাহাড়ি হাটে ১০০ টাকায় বিকোয় কিনা সন্দেহ।

ঢাঙ্গিকুসুম থেকে এবার শিমুল পাল, দূরত্ব ১০ কিমি। আবার চিড়াকুটি আসতে হবে তারপর ডাইনে শিমুলপাল। শিমুলপাল গ্রামেও কয়েক ঘর পাথর শিল্পী আছে। এরা পাথরের থালা, বাটি, গ্লাস বানায়। অর্ডার মাফিক বানায় মূর্তি, পঞ্চপ্রদীপ ইত্যাদি। শিল্পীদের জন্য বিডিও অফিস থেকে পাশে ঠাকুর পাহাড়ী গ্রামে একটি কমিউনিটি সেন্টার তৈরি করে দিয়েছে। সেখানে বসে জিনিস তৈরি, বিপনন এবং প্রদর্শনী করতে পারবে।

শিমুলপালের পর শেষ গন্তব্য কানাইসর পাহাড়। এখান থেকে দূরত্ব প্রায় ৫ কিলোমিটার। একেবারে ঝাড়খন্ড সীমান্তে অবস্থিত এই পাহাড়। এই পাহাড়কে দেবতা জ্ঞানে পূজা করা হয়। আষাঢ় মাসের তৃতীয় শনিবার বার্ষিক পূজা। সেদিন বিরাট মেলা বসে। পাহাড় ৭০০ মিটার উঁচু। বেশ কষ্ট করে উঠতে হয়। বিপদের সম্ভাবনাও আছে। তবে মেলা হয় নিচে। তবে এই পাহাড়ের রূপ যে কী অপরূপ পাহাড়ে না উঠলে বোঝা যাবেনা। একেই হয়তো বলে ভয়ংকর সুন্দর। সবচেয়ে সুন্দর লাগে পাহাড়ের ওপর থেকে নিচের ভূমিরূপ দেখতে। এবার ফেরার পালা। কানাইসর থেকে বেলপাহাড়ি ১০ কিলোমিটার।

ঝাড়গ্রাম থেকে খুব সকালে বেরোলে একদিনের মধ্যে কুলিয়ে যাবে হয়তো এই পুরো ভ্রমন। তবে একদিন কাঁকড়াঝোড়-এ থেকে পরের দিন শিমুলপাল অঞ্চলের ভ্রমণটি করলে ভালো হয়। ঝাড়গ্রাম থেকে একটি গাড়ি ভাড়া করে নিয়ে আসলে ভালো। সব জায়গাগুলো ঘুরে দেখার জন্য সর্বত্র গন পরিবহন মাধ্যম নেই। নিজের গাড়ি থাকলে তো কথাই নেই, তবে পথপ্রদর্শক আবশ্যক। শুধু গুগলে ভরসা করা যাবেনা।

চলবে…