এক নজরে

বউবাজারের ঝুলনবাড়িতে ঐতিহ্যমেনে আজও বসে জলসা

By admin

July 06, 2023

রাস্তার নাম আগে ছিল সেন্ট জেমস লেন। পালটে গিয়ে হয় বাবুরাম শীল লেন। পরবর্তীতে সে নামও বদলে যায়। রামকানাই অধিকারী লেনের ওই বাড়ি লোকমুখে ঝুলনবাড়ি নামেই সমধিক পরিচিত। ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রো রেল প্রকল্পের টানেল বোরিং মেশিনের কম্পন কিংবা মেট্রো কর্তৃপক্ষের অপরিণামদর্শিতা, অথবা নিছক আকস্মিক বিপর্যযয়ে একের পর এক  ভেঙ্গে, ফেটে ধসে পড়েছে সেই এলাকারই বাড়ি; আজও তেমনি আছে। রাস্তার ওপর চোখে পড়বেই ঠাকুরবাড়ি আর বাসগৃহকে জুড়েছে একটি ব্যালকনি, অনেকটা এস এন ব্যানার্জি রোডে কলকাতা পুরসভার বাড়িটির মতো। এই শহরে এরকম বাড়ি আর একটাও নেই।রামকানাই অধিকারী লেনের ওই বাড়ি কিন্তু আসলে ধনী ব্যবসায়ী বাবুরাম শীলের। রামকানাই-এর বাবা ধর্মদাস অধিকারী ছিলেন ওই বাড়ির কুলপুরোহিত। একদিন বাবুরাম ধর্মদাসের কাছে সবকিছু সমর্পণ করে কাশীবাসী হন। এরপর ধীরে ধীরে শীলের বাড়ি হয়ে যায় অধিকারী বাড়ি।

বউবাজারেই ছিল অন্য একটি পল্লি, সেখানে প্রতি রাতেই বসত গানের আসর। গহরজান, মালকাজান, মতিবাঈ প্রমুখ রীতিমতো আরেকটি বেনারস গড়ে তুলেছিলেন। রামকানাইকে সেসব টানেনি, তাঁর বাড়িতে বিরাজ করেন নবদ্বীপের শ্রীচৈতন্য, পুরীর জগন্নাথ আর বৃন্দাবনের রাধাকৃষ্ণ। বেলজিয়াম গ্লাসের আয়নায় প্রতিফলিত হয় গোটা মন্দির প্রতিফলিত হয়। ঝলমলে আলোর নাচঘর, ঠুমরির লাস্য, নূপুরের ঝংকার তার বাড়িতে শোনা যায় না। তবে ঝুলনের পাঁচদিন বিগ্রহের পাঁচরকম সাজ, পাঁচরকম ভোগ, তানপুরা, পাখোয়াজ, তবলাসহ ধ্রুপদের আসর আসর, যত মানুষ আসবেন তাদের খাওয়াদাওয়া…এসব নিজের হাতে করতেন রামকানাই। এরই ফাঁকে তিনি যদুনাথের সঙ্গে একটু রেওয়াজও সেরে নিতেন। কারণ বাড়ি ভর্তি শ্রোতাদের সামনে যাতে কোনও ভুলচুক না হয়। ধ্রুপদে ঈশ্বরের বন্দনা ছাড়াও থাকে লয়ের খেলা। একটি তালকে ছন্দে ফেলে যে লয়ের খেলা চলতে থাকে তা অভ্যাস না করে নিলে আত্মবিশবাস তৈরি হয়না। যদুভট্ট কেবল যে এ বাড়ির ঝুলনের আসরে গান গেয়েছিলেন তা নয়। তাঁর জীবনের অনেকটা সময় কেটেছিল এ বাড়িতেই, এখানেই তিনি মারা যান।

এ বাড়ির অলিন্দে খিলানে গানের বহু ইতিহাস লেপ্টে আছে, আনাচে কানাচে ছড়িয়ে আছে বহু গল্প। যদুভট্ট একবার কোনও কারণে অনুষ্ঠানের প্রথমদিন আসতে পারেন নি। কিন্তু পরেরদিনই বিষ্ণুপুর থেকে তিনি হাজির হয়ে যান। সকালবেলায় এসে তিনি বহুক্ষণ ধরে মন্দিরে ঠাকুর প্রণাম করেন। তারপর তিনি আগেরদিন না আসতে পারার জন্য ক্ষমে চেয়ে নিয়ে বলেন, গতকাল কি এখানে মাককোষ গাওয়া হয়েছিল? উপস্থিত সবাই বিস্মিত হন, ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন যদুভট্টের দিকে। সত্যিই তো কাল সন্ধ্যায় এখানে মালকোষ পরিবেশিত হয়েছিল। কিন্তু বিষ্ণুপুরে থেকে যদুভট্ট সে সুর শুনলেন কি ভাবে? আজও অধিকারী বাড়ির কেউ জানে না কেন, তবে বিজ্ঞান পড়া মানুষ জানেন দেওয়ালের শব্দের প্রতিধ্বনি ধরে রাখার ক্ষমতা আছে। কিন্তু কেবলমাত্র তিনিই কেন শুনতে পেলেন সেই প্রতিধ্বনি? সংগীতের মতোই প্রাচীন এবং ঐতিহ্যময় অধিকারী বাড়ির মিষ্টির পদ। প্রাচীন বাংলায় রসগোল্লা, সন্দেশ-এর আগেই এ বাড়িতে  সংগীতানুষ্ঠানের শেষে শিল্পী ও আমন্ত্রিত অতিথিদের ক্ষীর পরিবেশনের রেওয়াজ ছিল।  

আগে কেবলমাত্র ধ্রুপদ পরিবেশিত হত। ধীরে ধীরে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বলা যেতে পারে ধ্রুপদ চর্চা কমে যাওয়ার ফলেই খেয়াল, ঠুমরি, সেতার সরোদ ঝুলনের সময় পরিবেশিত হয়। আগে সন্ধ্যারতি, ভোগারতির পর শুরু হত গানের আসর। আসরে গাওয়ার জন্য শিল্পী সময়ও নির্দিষ্ট থাকত না, ভোর বেলা আসর শুনে সকলে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ফিরত। আজ ঝুলন বাড়িতে অনুষ্ঠান শুরু হয় সধ্যে সাতটায় শেষ রাত দশটয়। কেবল্মাত্র প্রতিষ্ঠিত শিল্পীরাই নয় বহু নবীন শিল্পীরাও এখানে সুযোগ পেয়ে আসছেন। তবে মার্গ সংগীত ছাড়া অন্য কোনও গান এ বাড়ির অনুষ্ঠানে পরিবেশিত হয় না। প্রসঙ্গত যদুভট্টের বর্তমান বংশধরেরা আজ আর বিশুদ্ধ মার্গ সঙ্গীতের চর্চায় বলেই তাঁদের আমন্ত্রণ জানানো হয় না।