এক নজরে

ভারত ও চীনের মধ্যে যুদ্ধ কি আদৌ সম্ভব

By admin

September 04, 2020

(দ্বিতীয় পর্ব)

ভারত – চিন সীমান্ত বিবাদ এবং যার ভয়াবহ পরিনাম গালওয়ান উপত্যকায় ২০ জন ভারতীয় সৈনিকের মৃত্যুর প্রতিবাদে চীন সামগ্রী বহিষ্কারের ডাক উঠেছিলো।| যার পদক্ষেপ স্বরূপ ভারত সরকার সে সময়েই ৫৯ টি চীন app উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে | যার মধ্যে ছিলো টিকটক কিংবা ইউসি ব্রাউজার ও। এই পর্বের উত্তেজনার ফল হিসেবে ২ সেপ্টেম্বর ভারত পাবজি সহ আরো ১১৮টি চীন app নিষিদ্ধ করে। পাবজি-র মতো জনপ্রিয় মোবাইল গেম ভারত নিষিদ্ধ করায় প্রথম দিনই বিপুল ক্ষতি হয় চিনের।

তবে বাণিজ্য নিষিদ্ধ করা হলে চিনের চেয়ে ভারতের ক্ষতি বেশি, এমনই দাবি একাংশের। চিন হলো এশিয়ার বৃহত্তম অর্থনীতি এবং বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি। ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ভারতের মাথা পিছু আয় ($৩৬৮) চিনের থেকে বেশি ছিল ($৩১৮) | বাণিজ্য কাঁচামাল আমদানি ও ভারতের স্টার্টআপ ও প্রযুক্তিতে বিনিয়োগে চিন ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম অংশীদার | ২০১৯ ও ২০২০ অর্থবর্ষে ভারত মোট রপ্তানির ৫ শতাংশ এবং আমদানির ১৪ শতাংশ চিনের সাথে করে যা মোট $৮৮ বিলিয়ন ডলার | ইনভেস্ট ইন্ডিয়া সংস্থার মতে, ২০০০ সালের পর থেকে চিন থেকে ভারতের আমদানি ৪৫ গুন বেশি হয়েছে যা মোট $৭০ বিলিয়ন ডলার | এছাড়া ভারত আমেরিয়ার সাথে ৭.৫৮ শতাংশ , সৌদি আরবের থেকে ৫.৬৫ শতাংশ , ইরাক থেকে ৪.৯৫ শতাংশ ও অন্যান্য দেশ থেকে ৫৪.১৮ শতাংশ আমদানি করে | রপ্তানির দিক থেকে চীন ভারতের তৃতীয় বৃহত্তম অংশীদার |

আমদানি ও রপ্তানির মধ্যে পার্থক্য অর্থনীতির ভাষায় ট্রেড ডেফিসিট বলা হয় | ভারত ও চিনের মধ্যে ট্রেড ডেফিসিট বা ঘাটতি হলো $৫৯ বিলিয়ন ডলার | ইন্ডিয়া সিঙ্গাপুরে বিজনেস এন্ড ইনোভেশন সাবমিটে ভারতের বিদেশ মন্ত্রী এস জয়শঙ্কর বলেন,ভারতের বাজারে চিনা উপকরনের বেআইনি প্রবেশ ও আরো কিছু কারণে ট্রেড ডেফিসিট সৃষ্টি হয়েছে |

ভারত ও চীনের আদানপ্রদান

ভারতের বিদেশ মন্ত্রক অনুযায়ী, চিন ভারতে স্মার্ট ফোন ইলেকট্রনিক প্রোডাক্ট পাওয়ার প্লান্ট সামগ্রী, টেলিকম সামগ্রী, মেট্রো রেল কোচ ,ওষুদের কাঁচামাল রপ্তানি করে | ভারত কেবল লৌহ আকরিক, রাসায়নিক সার ও অন্যান্য কাঁচামাল রপ্তানি করে থাকে |তাহলে চিনা পণ্য বহিস্কারে ভারতের ক্ষতি কেন?

একটি দেশের সাথে বাণিজ্যে ক্ষতি দেশ বা অর্থনীতিকে দুর্বল বা খারাপ করে তোলে না | চিনের সাথে ট্রেড ডেফিসিট-র অর্থ হলো ভারতীয় বাজারে চীন দ্রব্যের চাহিদার তুলনায় ভারতীয় দ্রব্যের চীনের বাজারে চাহিদা কম | চিন থেকে ভারতের আমদানি চিনের মোট রপ্তানির মাত্র ৩ শতাংশ আবার ভারত থেকে চিনের আমদানি যা চিনের মোট বাজারের ১ শতাংশ | চিনের শীর্ষ বাণিজ্যিক তালিকায় ভারতের অবস্থান ১১ |বাণিজ্যে চিনের প্রধান দেশ হলো ইউরোপ ও জাপান। ভারত চিনকে বয়কট করলে তেমন ক্ষতি চিনের হবে না | কিন্তু ভারত চিনের উপর কিভাবে নির্ভরশীল ? কয়েকটি ক্ষেত্র ধরে ভারতে চিনের প্রভাব লক্ষ করা যাক।

টেলিকম সেক্টর

চিনা স্মার্ট ফোন ভারতীয় বাজারের ৭২ শতাংশ দখল করেছে | ইন্টারন্যাশনাল ডাটা কর্পোরেশনের মতে, ২০১৯ সালে শীর্ষ স্থানীয় চিনা স্মার্ট ফোন ব্র্যান্ডের ভারতে বিক্রয় মোট ১৬ বিলিয়ন ডলারের বেশি | এছাড়া ভারতীয় টেলিকমুনিকেশন পরিষেবার মোট ১২ হাজার কোটির বাজারে চিনের প্রভাব প্রায় ৩ হাজার কোটি | এদের মধ্যে অন্যতম হলো ZTE ও HUAWEI র মতো কোম্পানি |

আমরা বিভিন্ন টেলিকম কোম্পানির থেকে ঠিকঠাক পরিষেবা পেতে হলে চিনা কোম্পানির প্রয়োজন কোথায় ?

যে কোনো 3G ,4G বা 5G পরিষেবারই প্রয়োজন রেডিও ট্রান্সমিশণ টাওয়ার এন্টিনা ও সার্ভার ইত্যাদি | যা টেলিকম কোম্পানি নিজে তৈরি করে না। তারা অন্যদের থেকে কেনে | ভারতে এই উপকরণ গুলির সাপ্লাই অনেক কোম্পানি করে থাকে যেমন NOKIA ও ERICSSON, চিনা কোম্পানি ZTE ও HUAWEI | বর্তমানে IDEA VODAFONE কোম্পানির ৪০ শতাংশ AIRTEL এর ৩০ শতাংশ ও ভারত সরকার দ্বারা পরিচালিত BSNL এ ৪০ শতাংশ উপকরণ চিনা কোম্পনির | চিনা উপকরণ ইউরোপীয় ও অন্যান্য দেশ যেমন দক্ষিণ কোরিয়ার কোম্পানির থেকে ৩০শতাংশ সস্তা ও এরা পেমেন্টের জন্য টেলিকম কোম্পানি গুলিকে অনেক সময় দেয় আর সার্ভিসও অনেক ভালো |ভারত সরকারের বহিষ্কারের নীতির ফলে টেলিকম কোম্পানিগুলি যদি অন্য দেশ থেকে বেশি দামি উপকরণ কেনে তবে তার ফলে ভারতে 5G পরিষেবা দামি হবে।

ভারত সরকারের এই নীতি একাংশ সমর্থন করেনি ।COAI (সেলুলার অপেরেটর এসোসিয়েশন অফ ইন্ডিয়া )-র মতে সীমান্ত বিবাদের প্রভাব বাণিজ্যে না পড়া ভালো ভারত সরকার কে এই বিষয়ে বিবেচনা করা উচিত | কিন্তু নদীর বড় মাছ যেমন ছোট মাছকে গ্রাস করে তেমনি চিনা কোম্পানিগুলো ভারতের ছোট কোম্পানিগুলো কে গ্রাস করছে | চিনা উপকরণ একেবারে বহিস্কার করলে প্রথম পর্যায় ক্ষতি হলেও পরবর্তী কালে স্বদেশী কোম্পানিগুলির জন্য লাভদায়ক হবে | আমেরিকা ফেডারেশন কমিউনিকেশন কমিশন রাষ্ট্রীয় সুরক্ষার জন্য HUAWEI ও ZTE কে বহিস্কার করেছে | তাদের মতে, এই দুই কোম্পানির সাথে চিনা কমুনিস্ট পার্টি এবং চিনা সেনাবাহিনীর যোগসূত্র আছে | ২০০৯ সালে এমন অভিযোগ ভারতে প্রথমবার ভারতে ওঠে | বারাক ওবামা প্রশাসন ZTE কে ৭ বছরের জন্য ব্যান করে | ২০১৮ সালে ট্রাম্প সরকার $৫১ আরব ডলার ও উচ্চ সুরক্ষার শর্তে মার্কিন মুলুকে পুনরায় ZTE কে ব্যাবসার অনুমতি দেন।পরবর্তী কালে ব্ল্যাক লিস্ট করা হয় |

ফার্মা সেক্টর

২০১৮ – ২০১৯ সালে সারা বিশ্বে ভারত মোট $১৯.১৩ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য করে যা ২০১৯ ও ২০২০ সালে আনুমানিক $১৩.৬৯ বিলিয়ন ডলার বাণিজ্য হতে পারে ( জানুয়ারী পর্যন্ত ) যা ৩০% বৃদ্ধি পেতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে | এই সেক্টরেও চিনা প্রভাব দেখা যাক | ঔষধ তৈরির ক্ষেত্রে active pharmaceutical ingredient এর প্রয়োজন হয় যা ভারত ৬৫ থেকে ৭০ শতাংশ চিন থেকে আমদানি করে | চিনা প্রভাব কমানোর জন্য বর্তমানে ভারত সরকার ১০ হাজার কোটির প্যাকেজে ঘোষণা করে যাতে স্বদেশী ভাবে active pharmaceutical ingredient তৈরিতে সক্ষম হয় । কিন্তু তা পুরো হতে আনুমানিক ৫ বছর লাগতে পারে |

অটো সেক্টর

বিশ্বের কারখানা হিসাবে, চিন গড় ভারতীয় গ্রাহককে তার শপিংয়ের কারের শখটি পূরণ করতে সহায়তা করে| সুতরাং, এটি ভারতে অটোমোবাইল ক্রেতাদের কাছে একটি বিস্ময়কর বিষয় হয়ে উঠতে পারে যে তাদের গাড়ি এবং বাইকের গুরুত্বপূর্ণ উপাদানগুলি – সবচেয়ে টেকসই এবং ব্যয়বহুল ভোক্তা পণ্যগুলি আর চিন থেকে আসবে না |২০১৯ সালে ভারতীয় অটো সেক্টরে প্রায় $ ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের চিনা বিনিয়োগ আছে | করোনা ভাইরাস প্রাদুর্ভাব ভারতীয় অর্থনীতিতে খারাপ প্রভাব ফেলেছে এবং ব্যবসায়ের ঘাটতি ঘটায়, দেশীয় অটোমোবাইল শিল্পটি প্রায় ১৩,০০০ কোটি থেকে ১৫,০০০ কোটি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে | তার উপর সরকারের এইরূপ মনোভাব চিন্তায় ফেলেছে ভারতীয় অটো সেক্টরকে | এক বক্তব্যে ভারতের অটো-জায়েন্ট মারুতি সুজুকি দেশে চিনা আমদানিতে শুল্ক বাড়ানোর জন্য ভারতের পদক্ষেপের প্রতি তার অসন্তোষের কথা জানায়। সংস্থাটি যুক্তি দিয়েছিলো, যানবাহন উৎপাদন করার জন্য চাইনিজ আমদানি প্রয়োজনীয় এবং নির্মাতাদের চেয়ে ক্রেতাদের এটির বেশি প্রয়োজন।

ব্যাঙ্কিং সেক্টর

ভারতের অন্যতম ব্যাঙ্ক HDFC তে সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক অফ চিনের ১ শতাংশ বিনিয়োগ রয়েছে যা ১.১৫ কোটি টাকার অংশীদারিত্ব। তাছাড়া ভারতীয় শীর্ষ স্টার্ট আপ কোম্পানিগুলির উপর চিনের প্রভাব বর্তমান | tracxn data সংহার রিপোর্ট অনুযায়ী,২০১৯ সালে ভারতে মোট $১৪ বিলিয়ন স্টার্টআপস বাজারে প্রায় $২ বিলিয়ন চিনা কোম্পানিগুলির বিনিয়োগ রয়েছে | এদের মধ্যে অন্যতম paytm যাতে ২.২ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ আছে ALIBABA , ZOMATO তে ৯১৪.৬ মিলিয়ন , ফ্লিপকার্ট এ ৭.২ বিলিয়ন , OLA তে ৩.৮ বিলিয়ন বিনিয়োগ রয়েছে। এছাড়া বলিউড তারকা শাহরুক খান দ্বারা প্রচারিত BYJU’S অনলাইন শিক্ষা এপ্লিকেশনে $১.৪ বিলিয়ন বিনিয়োগ চীন কোম্পানি টেন্সেন্ট হোল্ডিংসের রয়েছে ক্রিকেট তারকা মহেন্দ্র সিং ধোনি র প্রচারিত অনলাইন গেমিং এপ্লিকেশন DREAM11 এ FOSUN নামক চিনা কোম্পনির প্রায় ৯৩৪ মিলিয়ন বিনিয়োগ রয়েছে | প্রায় ১৮ টি শীর্ষ ইউনিকর্ন এপ্লিকেশনে চিনের প্রভাব রয়েছে।