এক নজরে

বিস্মৃতপ্রায় স্বাধীনতা সংগ্রামী শান্তশীলা পালিত

By admin

August 15, 2020

সুখেন্দু হীরা

আজ থেকে প্রায় ১০০ বছর আগে এক বিধবা মহিলা স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। সেটা খুব বড় ব্যাপার নয়, তখন দেশের দাবি তেমনই ছিল। শুধু যে স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগদান করেছিলেন তা নয়, ব্রতী হয়েছিলেন সমাজসেবা ও নারী শিক্ষা বিস্তারে। নিজের ভিটেমাটি উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন সে কাজে।এখানেই শেষ নয়, নিজের সন্তানদের উদ্বুদ্ধ করেছিলেন দেশের মুক্তি আন্দোলনে যোগ দিতে। একাধারে জননেত্রী, সমাজসেবী এবং আদর্শ জননী। এরকম ভূমিকা পালন করতে খুব কম সংখ্যক মহিলাকে দেখা গেছে। কিন্তু সেই মহান মহিলা আজ বিস্মৃতপ্রায়। সেই স্বাধীনতা সংগ্রামীর নাম শান্তশীলা পালিত।

শান্তশীলা পালিতের পূর্ব নাম ছিল শান্তশীলা বসু। পিতা প্রসন্নকুমার বসু। জন্মস্থান অধুনা পূর্ব বর্ধমান জেলার গোবিন্দপুর গ্রামে। যা কালনা থানার অন্তর্গত। বাংলা ২১শে ভাদ্র ১২৮৯ সালে (১৮৮২ খ্রিস্টাব্দ) জন্ম। বাঁকুড়া জেলার পাত্রসায়র থানার অন্তর্গত বেতুর গ্রামের শরৎচন্দ্র পালিতের সঙ্গে বিবাহ হয়। স্বামীর মৃত্যুর পর পূর্ববঙ্গের কুমিল্লাতে নিজের ভাই ডাঃ নৃপেন্দ্রনাথ বসুর কাছে চলে আসেন। ভাই কর্মসূত্রে বসবাস করতেন কুমিল্লাতে। নৃপেন্দ্রনাথ বসু ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী, মহাত্মা গান্ধীর অনুগামী এবং নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর সহকর্মী। ১৯২১ সালে কুমিল্লায় অভয় আশ্রম প্রতিষ্ঠা হয়। প্রথমে আশ্রমের নাম ছিল সবিতা মিশন। পরে মহাত্মা গান্ধী এর নামকরণ করেন অভয় আশ্রম। জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দ, যেমন ডঃ প্রফুল্ল কুমার ঘোষ, বাঃ সুরেশচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় প্রমুখ ছিলেন স্থাপন করার সময়। তখন নিপেন্দ্রনাথ বসু ছিলেন সেই দলে। পরে সারা বাংলায় অভয় আশ্রম এর শাখা গড়ে ওঠে। কুমিল্লায় অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শান্তশীলাদেবী অভয় আশ্রমে গঠনমূলক কাজে আত্মনিয়োগ করেন। এজন্য তিনি কুমিল্লাতে জননেত্রী হিসাবে খুবই সুপরিচিত ছিলেন। বাঁকুড়াতে শ্বশুরের ভিটেতেও অভয় আশ্রম খোলেন।

শান্তশীলাদেবীর দুই ছেলে সুশীলচন্দ্র পালিত এবং জগদীশচন্দ্র পালিত। তাঁরা ১৯২৩-২৪ সালে কুমিল্লা থেকে বাঁকুড়া আসেন খদ্দর প্রচার, হরিজন উন্নয়ন সমিতি গঠন, পাঠাগার গঠন এবং কংগ্রেসের গঠন মূলক কাজের জন্য। ১৯৩০ সালে লবণ সত্যাগ্রহের সময় বাঁকুড়া থেকে মেদিনীপুর কাঁথি পর্যন্ত পদযাত্রায় নেতৃত্ব দিতে আসেন ডাঃ সুরেশচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় এবং ডঃ প্রফুল্ল কুমার ঘোষ। কমিটির সম্পাদক ছিলেন সুশীলচন্দ্র পালিত। এটি ছিল বাংলার প্রথম এবং ভারতের দ্বিতীয় লবণ সত্যাগ্রহ পদযাত্রা। যাত্রাপথ ছিল বেলিয়াতোড় – সোনামুখী – পাত্রসায়ের – বর্ধমান – কাঁথি। জগদীশচন্দ্র পালিত সেই যাত্রায় ছিলেন এবং কাঁথিতে লবণ আইন ভঙ্গ করার জন্য আড়াই বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। আরেক ছেলে সুধীরচন্দ্র পালিত এবং পুত্রবধূ সুষমা আইন অমান্য করে কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। চতুর্থ সন্তান পঞ্চানন মেদিনীপুরে গ্রেফতার হন এবং মেদিনীপুরের জেলে অত্যাচারে তার মৃত্যু ঘটে।কলকাতার মহাজাতি সদনে শান্তশীলা এবং পঞ্চাননের তৈলচিত্র আছে। ১৯৩০ সালে লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণের জন্য শান্তশীলাদেবী এক বছর কারাবরণ করেন। ১৯৩১ সালে তার বাড়ি দখল করে পুলিশ সেখানে ফাঁড়ি তৈরি করে। সুশীল ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময়ও গ্রেফতার হন। স্বাধীনতার পর শান্তা দেবী বিভিন্ন সমাজ মূলক কাজে লিপ্ত হন। ৮ ভাদ্র ১৩৫৮ বঙ্গাব্দে (১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে) ৬৯ বছর বয়সে তার জীবনাবসান ঘটে শ্বশুরের ভিটেতে।কিন্তু সেই ভিটেতে আজ কোন গৃহের অবশেষ নেই। অভয় আশ্রমও অবলুপ্ত। সেই জমিতে একটি আইসিডিএস সেন্টার (সুসংহত শিশু বিকাশ কেন্দ্র) আছে। একটিমাত্র আনন্দের বিষয় ভবনটি তাঁরই নামে। সেন্টারের মূল দরজার উপরে লেখা আছে “শান্তশীলা পালিত”। বাঁকুড়াবাসী তথা বঙ্গবাসী মনে রাখুক বা নাই রাখুক, জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে বাঁকুড়া জেলার পালিত পরিবারের অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।