এক নজরে

কলকাতায় হুসেনের ছবি দেড়শো টাকাতেও বিক্রি হয়নি

By admin

September 19, 2022

এরপর একদিন খিচদিওয়ালা তাঁর মায়ের পোর্ট্রেট করাতে চাইলেন। ছেলেটি কয়েকটি স্কেচ করে একটি ধারণা নিলেন। তারপর একটি গোটা দিন শাবারের কাছে কামাই করে কাগজ কিনে কয়েক ঘন্টায় খিচদিওয়ালার মায়ের পোর্ট্রেটটি শেষ করল সেই ছেলেটি। রিয়েলিস্টিক সেই পোর্ট্রেটে কেবল এক নারীর চেহাড়া নয়, ব্যক্তিত্বও ধরা পড়ল। খিচদিওয়ালা মায়ের ছবি আঁকিয়ে ছেলেটিকে যথেষ্ট সম্মান করে বললেন, ‘এক মাস তোমার কাছ থেকে খাবারের দামই নেব না’। শাবাবের কাছে কাজ করতে করতে ছেলেটি কাঠের কাজ শিখল। মাচা বানিয়ে ফ্রেমে চট ঢুকিয়ে টানটান করে তাতে বিলবোর্ড বানানো। ইতিমধ্যে হোর্ডিং আঁকার কাজ করে বিশাল ফ্রেমে ছবি আঁকার কাজটা পোক্ত করে ফেলেছে। তবে শরীর আর মনের জোর সবসময় একরকম থাকে না।

প্রতিদিন এবেলা-ওবেলা অপুষ্টিকর খাবার শরীরের ওপর চাপ পরবেই। দু-একবার উঁচু মাঁচায় উঠে মাথা ঘুরে গিয়েছে। ওপর থেকে পড়ে গিয়ে মাথা ফেটেছে। কঠিন আমাশয় হয়েছে। গ্যালন গ্যালন তিসির তেল, কেরোসিন, দস্তার রঙের ঘ্রাণ টানতে টানতে দুরারোগ্য কাশি হয়েছে। মুসলমান বিধবা মেহমুদা বিবি তাঁর বাড়িতে একটি মেস চালাতেন। যুবকটি সেখানে গিয়ে উঠলেন। একবার দুমাসের বকেয়া ভাড়া বাকি পড়ে গেল। তার ছেলে একদিন বিছানা-বালিশ রাস্তায় ছুড়ে ফেলে দিয়ে যুবকটিকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিলেন। ঠিক এই সময় যুবকটি একাই পেল জিন্দেগি ছবির হোর্ডিং তৈরির কাজ। পরদিন ভোরের আগে মারাঠি সিনেমার নায়িকা দুর্গা খোটের ৪০ ফুট কাট-আউট তৈরি করতে হবে। মাঝরাত থেকে ভোর চারটা পর্যন্ত ট্রাম চলাচল বন্ধ। রাস্তার এ মোড় থেকে ওই মোড় পর্যন্ত ক্যানভাস বিছিয়ে দিয়ে যুবকটি চারটে বাজার আগেই কাট-আউট শেষ করে ফেলল। 

জিন্দেগি’র কাট আউট করে তাঁর হাতে বেশ কিছু টাকা এল। সব পাওনাদারের টাকা শোধ করে মেহমুদা বিবির হাতেও তুলে দিলেন দুমাসের বকেয়া-সহ আগাম দু’মাসের টাকা। অপদস্থ হলেও সে বাড়িতে বাড়তি আকর্ষণ ফজিলা,  মেহমুদা বিবির মেয়ে। ইতিমধ্যে তাকে যুবকটি দশ পাতার একটি প্রেমপত্র লিখেছে। সবাই বিরোধিতা করেছে, এমন চালচুলোহীন ভবঘুরের সঙ্গে মেয়ে বিয়ের প্রশ্নই আসে না, কিন্তু মেহমুদা বিবির মৌন সমর্থনে কিছু খেজুর বিতরণ করে তাদের নিকাহ সম্পন্ন হয়। বিয়ের দিনও বিকেল সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত সেই যুবক সিনেমার হোর্ডিং এঁকেছে। সিনেমার হোর্ডিং আঁকতে আঁকতেই তিনি একদিন মকবুল ফিদা হুসেন হয়েছেন। হুসেনের প্রথম একক প্রদর্শনী হয় বোম্বেতে। দ্বিতীয়টি কলকাতা আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে। সে-সময়কার বাংলার সবচেয়ে খ্যাতিমান শিল্প-সমালোচক ও সি গাঙ্গুলি তাঁর কাজের ওপর সিল মেরে দেন, ‘বিট্রেয়াল অব যামিনী রায়’ অর্থাৎ যামিনী রায়ের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা।

এরপর উনিশশো পঞ্চাশ-একান্নতে ফের তিনি কলকাতায় ছবি নিয়ে এলেন প্রদর্শনীতে। অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসের বার্ষিক প্রদর্শনীতে তাঁর ছবি জায়গা পেলেও মাত্র দেড়শো টাকাতেও বিক্রি হয়নি তাঁর একটিও ছবি। কিন্তু হুসেন কলকাতায় পড়ে রইলেন। কারণ, ফিরতি টিকিট কিনে বোম্বেতে ফিরে যাওয়ার মতো পয়সাও তাঁর হাতে নেই। অথচ বছর দশেক পরই হুসেনের ছবির দাম উঠেছে কয়েক লক্ষ টাকা। তাঁর ছবি হয়ে ওঠে সংগ্রাহকের সম্পদ। এক-একটি ছবির দাম পৌঁছেছে কোটির ঘরে। দীর্ঘ জীবনে পেয়েছেন অজস্র স্বীকৃতি। কিন্তু অন্তত পঁয়তাল্লিশ বছর বয়স পর্যন্ত জীবন নির্বাহের জন্যে, ছবি আঁকার সরঞ্জাম কেনার জন্য এঁকেছেন সিনেমার হোর্ডিং, রং করেছেন কাঠের খেলনা, দোকানের জন্য নতুন নতুন নকশার আসবাবও এঁকেছেন। দীর্ঘকাল তাঁর স্টুডিয়ো ছিল গ্র্যান্ট রোডের ফুটপাথ।