এক নজরে

ইমরান খানও পাকিস্তানের ইতিহাস বদলাতে ব্যর্থ

By admin

March 31, 2022

দু’দিন আগে ইমরান শরিক পিএমএল-কিউকে পঞ্জাব প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর পদ ছেড়ে চাল চেলেছিলেন। কিন্তু তুরুপের তাসে বিরোধীরা বেসামাল হয়ে পড়েননি বরং আরও বড় ধাক্কা খায় ইমরানের পিটিআই। এরপর আর এক জোটসঙ্গী বালুচিস্তান আওয়ামি পার্টিও সরকারের হাত ছেড়েছে। মুত্তেহিদা কাওয়ামির সমর্থন হারানোয় সংসদে ইমরানের দলের সদস্য সংখ্যা ১৫৫ আর বিরোধী দলের সদস্য সংখ্যা পৌঁছেছে ১৭৭-এ।

ইমরান খানের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাবে বিরোধীদের জয়লাভের জন্য প্রয়োজন ১৭২টি ভোট। হিসাব অনুযায়ী ভোটে বিরোধীদের জয় প্রায় নিশ্চিত। আগামী ৩ এপ্রিলই সংসদে অনাস্থা প্রস্তাবের ভোটাভুটি রয়েছে। তার আগে বৃহস্পতিবার পাকিস্তানের নিম্নকক্ষে অনাস্থা প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করা হবে। বিরাট অঘটন না ঘটলে ইমরান খানকে গদি ছাড়তেই হচ্ছে। উল্লেখ্য, ইমরান খান হলেন পাকিস্তানের তৃতীয় প্রধানমন্ত্রী, যাকে অনাস্থা প্রস্তাবের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। তাঁর আগে পাকিস্তানের কোনও প্রধানমন্ত্রীকে অনাস্থা প্রস্তাবের জেরে গদিচ্যুত হতে হয়নি।

ইমরান খান ২০১৮ সালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পান। ২০২৩-এর আগস্ট পর্যন্ত তাঁর মেয়াদ কিন্তু তার আগেই সে দেশের টলমল অর্থনীতির জন্য ইমরান খানকেই সকলে কাঠগড়ায় তুলেছে। বিরোধীদের দাবি, দেশের অর্থনীতি, বিদেশ নীতি-কিছুই তিনি সামলাতে পারছেন না। এমনকি শাসক দলেরও অনেকের দাবি, ইমরান খান দেশ সামলাতে ব্যর্থ। পাশাপাশি পাক সেনাবাহিনীর সঙ্গেও তাঁর সম্পর্ক ভাল নেই।অন্যদিকে, ইমরান খানের অভিযোগ যে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করতে বিদেশ থেকে চক্রান্ত চলছে। সম্প্রতি ইসলামাবাদে একটি জনসভায় তিনি দাবি করেছেন, তাঁর দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফকে পাকিস্তানের মসনদ থেকে হটানোর চেষ্টা হচ্ছে। বিদেশ থেকে আসা অর্থ সাহায্যের প্রমাণও রয়েছে তাঁর কাছে।

প্রসঙ্গত, কেয়ারটেকার প্রধানমন্ত্রী সহ এ পর্যন্ত ১৮ জন প্রধানমন্ত্রী পাকিস্তানের গদিতে বসেছেন। এদের কেউ সামরিক অভ্যুত্থান, আততায়ীর গুলিতে নিহত, সেনাবাহিনীর চাপে, কেউ আদালতের নির্দেশে আবার কেউ আস্থা ভোটে হেরে পাঁচ বছর মেয়াদের আগেই ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন একমাত্র শওকত আজিজ ব্যাতিক্রম।

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম প্রধানমন্ত্রী হন নবাবজাদা লিয়াকত আলি খান। কিন্তু মেয়াদ পূর্তির আগেই আততায়ীর গুলিতে নিহত হন তিনি। ১৯৫১ সালের ১৬ অক্টোবর রাওয়ালপিন্ডির একটি সভায় ১৫ গজ দূর থেকে সাদ আকবর নামে এক ব্যক্তি তাকে গুলি করে হত্যা করে।এরপর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন ঢাকার নবাব পরিবারের খাজা নাজিমুদ্দিন। তাঁর সময় অভ্যন্তরীণ বিবাদ এবং কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ বৃদ্ধি পাওয়ায় দু’বছরের মাথায় তাঁকে পদচ্যুত করা হয়। তার সময়েই বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা মর্যাদা দেওয়ার দাবিতে ঢাকায় যে মিছিল হয় তাতে পুলিশ গুলি চালায়।এরপর আরেক বাঙালি বগুড়ার মোহাম্মদ আলি পাকিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতায় বসেন। তার সময়ে পাকিস্তানের সংবিধানের খসড়া তৈরির একটি কমিটি গঠিত হয় আবার তা ভেঙেও দেওয়া হয়। ফলে মোহাম্মদ আলি নতুন মন্ত্রিসভা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। কিন্তু পরবর্তীতে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা মোহাম্মদ আলিকে পদত্যাগে বাধ্য করেন।পাকিস্তানের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হন চৌধুরী মোহাম্মদ আলী। কিন্তু নিজের দল মুসলিম লীগের ভেতরেই বিরোধীরা রিপাবলিকান পার্টি নামের আরেকটি রাজনৈতিক দল গঠন করলে মুসলিম লীগ তাঁর ওপর চাপ সৃষ্টি করে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে তিনি পদ ছাড়তে বাধ্য হন।

পাকিস্তানের এর পরের প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণে পদক্ষেপ নেন। উর্দুর সঙ্গে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবেও স্বীকার করে নেওয়া হয়। এই পদক্ষেপে অসন্তুষ্ট হয় পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা। পরবর্তী পদক্ষেপ সামরিক শাসন এবং নিরাপত্তা আইনে রাষ্ট্রবিরোধী কাজের অপরাধ দেখিয়ে সোহরাওয়ার্দীকে গ্রেফতার করে করাচি সেন্ট্রাল জেলে আটক রাখা হয়।এরপর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসেন ফিরোজ খান নুন। তাঁকেও সামরিক শাসন জারি করেন পদচ্যুত করা হয়। লম্বা সামরিক শাসন শেষে ১৯৭৩ সালে পাকিস্তানের সংবিধান পরিবর্তন করে প্রধানমন্ত্রী হন জুলফিকার আলী ভুট্টো। কিন্তু জেনারেল জিয়াউল হকের নেতৃত্বে সামরিক অভ্যুত্থানে তিনিও ক্ষমতাচ্যুত হন। হত্যার ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার অভিযোগে জুলফিকার আলী ভুট্টোকে ১৯৭৯ সালে সামরিক আদালত মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করে।

এরপর জিয়াউল হক মোহাম্মদ খান জুনেজোকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেন। জুনেজো সামরিক প্রভাবমুক্ত সরকার গঠনের চেষ্টা চালালে জিয়াউল হক তাঁকে ১৯৮৮ সালে বরখাস্ত করেন ।এরপর নির্বাচনের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন জুলফিকার আলী ভুট্টোর মেয়ে বেনজির ভুট্টো। মুসলিম দেশগুলোর প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী তিনি।তবে তিনিও বরখাস্ত হন কিন্তু ১৯৯৩ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে ফের তিনি প্রধানমন্ত্রী হন। ১৯৯৬ সালে বেনজির পুনরায় বরখাস্ত হন। ১৯৯৭ সালের নির্বাচনে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে হেরে যান। ১৯৯৯ সালে বেনজির ও তার স্বামী আসিফ আলী জারদারিকে সুইজারল্যান্ডের একটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ঘুষ নেয়ার অভিযোগে পাকিস্তানের একটি আদালত পাঁচ বছরের কারাদণ্ড ও ৮৬ লাখ ডলার জরিমানা করে। আট বছরের স্বেচ্ছানির্বাসন কাটিয়ে ২০০৭ সালে বেনজির পাকিস্তানে ফেরেন। ২০০৭ সালে রাওয়ালপিন্ডির এক নির্বাচনী সমাবেশ শেষে তিনি আত্মঘাতী হামলায় নিহত হন।

এরপর পাকিস্তানে তিনবারের জন্য প্রধানমন্ত্রী হন মিয়া মুহম্মদ নওয়াজ শরিফ। প্রথমবার ১৯৯০ সালের ১ নভেম্বর থেকে ১৯৯৩ সালের ১৮ জুলাই, দ্বিতীয়বার ১৯৯৭ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৯৯৯ সালের ১২ অক্টোবর, কিন্তু ১৯৯৯ সালে জেনারেল পারভেজ মোশাররফ এক সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে নওয়াজ শরিফকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। ২০১৩ সালে নওয়াজ শরিফ তৃতীয়বার ক্ষমতা লাভ করলেও নিজের ও পরিবারের সদস্যদের বিপুল পরিমাণ সম্পদের উৎস জানাতে ব্যর্থ হওয়ায় নওয়াজকে অযোগ্য ঘোষণা করেন দেশটির সুপ্রিম কোর্ট। এরপর মেয়াদ পূর্তির আগে পদত্যাগ করেন নওয়াজ।উল্লেখ্য, ২০০২ সালে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন জাফরুল্লাহ খান জামালি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁকেও পদত্যাগে বাধ্য করা হয়। ২০০৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হন শওকত আজিজ। তিনি পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী, যিনি ওই পদে তার মেয়াদ পূর্ণ করতে পেরেছিলেন।২০০৮ সালের ২৪ মার্চ পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) থেকে মনোনয়ন পেয়ে প্রধানমন্ত্রী হন ইউসুফ রাজা গিলানি। ২০১২ সালে প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় সংবিধান লঙ্ঘনের এক মামলায় ৩০ সেকেন্ডের এক প্রতীকী কারাদণ্ড দেয়া হয় তাকে। এতে ক্ষমতাচ্যুত হন গিলানি।