আমাদের খাদ্য ও পানীয় জল দূষিত করার পর এখন মানবদেহের জনন অঙ্গেরও ক্ষতি করছে প্লাস্টিক কণা। হিউম্যান রিপ্রডাকশন জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে দেখা গেছে, মানববীর্য ও ডিম্বাণুর ফলিকুলার তরলেও প্লাস্টিক কণা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে বলে দাবি করেছেন গবেষকরা। ১ জুলাই প্যারিসে আয়োজিত ইউরোপীয় সোসাইটি অব হিউম্যান রিপ্রোডাকশন অ্যান্ড এমব্রায়োলজির ৪১তম বার্ষিক সম্মেলনে ওই গবেষণার সারসংক্ষেপ প্রকাশ করা হয়। ২৫ জন নারী এবং ১৮ জন পুরুষের ছোট একটি দলের ওপর গবেষণা চালিয়ে বিজ্ঞানীরা দাবি করছেন, ৫৫ শতাংশ বীর্য এবং ৬৯ শতাংশ ফলিকুলার তরলের (ডিম্বাণুকে ঘিরে রাখা তরল) নমুনায় মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। মাইক্রোপ্লাস্টিক হচ্ছে অতিসূক্ষ্ম পলিমার কণা, যার আকার এক মাইক্রোমিটার থেকে সর্বোচ্চ পাঁচ মিলিমিটার পর্যন্ত।
ওই গবেষণাপত্রের প্রধান গবেষক ড. এমিলিও গোমেজ সানচেজ বলেছেন, আগের একাধিক গবেষণায় মানবদেহে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতির ধারণা পাওয়া গেছে। তাই এই ফলাফল আমাদের জন্য অপ্রত্যাশিত না হলেও এর ব্যাপ্তি ছিল আশঙ্কাজনক। এর আগের কিছু গবেষণায়, মানবদেহের ফুসফুস, প্ল্যাসেন্টা, মস্তিষ্ক, পুরুষাঙ্গ, অণ্ডকোষ এমনকি মলের মধ্যেও মাইক্রোপ্লাস্টিকের নমুনা খুঁজে পেয়েছিলেন বিজ্ঞানীরা। সানচেজ আরও বলেন, সাধারণত খাদ্য, শ্বাস-প্রশ্বাস এবং সরাসরি ত্বকের মাধ্যমে মানবদেহে মাইক্রোপ্লাস্টিক প্রবেশ করে বলেই গবেষকদের ধারণা। এরপর সেখান থেকে রক্ত পরিবহনতন্ত্রে মিশে গিয়ে পুরো দেহ, এমনকি জনন অঙ্গেও ছড়িয়ে পড়ে। এই সব মাইক্রোপ্লাস্টিক সরাসরি দেহে কোনও বিষক্রিয়া তৈরি করে, এমন কোনও প্রমাণ এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি বলে দাবি করেন সানচেজ। তবে, প্লাস্টিক তৈরিতে ব্যবহৃত রাসায়নিকের প্রভাবে মানবদেহের হরমোন উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটা বা ক্যান্সারের মতো ভয়াবহতার দিকে ঠেলে নেওয়ার আশঙ্কা কখনও উড়িয়ে দেননি বিজ্ঞানীরা।
মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণ থেকে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক উভয় পর্যায়েই পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা। ব্যক্তিগত স্তরে করণীয়ের মধ্যে রয়েছে, প্লাস্টিক বোতলের জল খাওয়া কমানো, প্লাস্টিক পাত্রে খাবার গরম না করা, কাচ, ইস্পাত বা বাঁশের পাত্রে খাবার সংরক্ষণ, প্লাস্টিক কাটিং বোর্ড পরিহার, অতিপ্রক্রিয়াজাত খাবার খাওয়া কমানো ইত্যাদি। তবে, এই সমস্যার কার্যকর সমাধানে ব্যক্তিগত পর্যায়ের চেয়ে সামাজিক পর্যায়ে ব্যবস্থা গ্রহণ বেশি জরুরি। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. ফিলিপ ল্যান্ড্রিগান বলেন, গত ৭৫ বছরে বিশ্বে প্লাস্টিক উৎপাদন ২৫০ গুণ বেড়েছে এবং ২০৬০ সালের মধ্যে এটি আবার তিনগুণ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই জাতিসংঘের গ্লোবাল প্লাস্টিক চুক্তিতে বিশ্বব্যাপী প্লাস্টিক উৎপাদনে সীমা নির্ধারণ জরুরি। পরীক্ষায় দেখা যায়, নারীদের ৬৯ শতাংশ এবং পুরুষদের ৫৫ শতাংশের নমুনায় মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি দেখা গেছে। চুলের চেয়েও সরু ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণাগুলো এখন রক্তসহ মানবদেহের এমন সব অপ্রত্যাশিত জায়গায় পাওয়া যাচ্ছে, যা আগে আমাদের ভাবনারও বাইরে ছিল।
এর আগে ২০২১ সালে ইতালির কিছু স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ প্রতিটি গর্ভনালিতে গড়ে ১২টি প্লাস্টিক কণা পেয়েছিলেন। যা প্রমাণ করে, পাঁচ মিলিমিটারের ছোট কণাগুলো মাতৃ-ভ্রূণ সীমানা ভেদ করতে পারে। একইভাবে প্লাস্টিক কণা অস্ত্রোপচারের সময় ফুসফুসের টিস্যু থেকেও পাওয়া গেছে। এর থেকে স্পষ্ট যে শ্বাসপ্রশ্বাসের মাধ্যমে প্লাস্টিক ধূলিকণা শরীরে প্রবেশ করতে পারে। প্লাস্টিক কণা মানবদেহে প্রবেশ করে- সাধারণত খাবার, জল পান ও শ্বাসপ্রশ্বাসের মাধ্যমে প্লাস্টিকের ক্ষুদ্র কণা মানবদেহে প্রবেশ করতে পারে। এই কণা অত্যন্ত ক্ষুদ্র। তাই তা হজমনালি বা ফুসফুসের পাতলা স্তর ভেদ করে ঢুকে যেতে পারে। প্রাণীর ওপর গবেষণায় দেখা গেছে, এক মাইক্রোমিটারের কম আকারের কণা কোষে সরাসরি প্রবেশ করতে পারে। বড় কণাগুলো শরীরের টিস্যুতে আটকে গিয়ে প্রদাহ সৃষ্টি করে। ইঁদুরের ওপর করা এক গবেষণায় দেখা গেছে, যখন মাইক্রোপ্লাস্টিক চর্বির সঙ্গে মিশে থাকে, তখন তা হজমনালি দিয়ে শরীরে প্রবেশের হার বেড়ে যায়।
বিজ্ঞানীরা লক্ষ্য করেন, এসব কণায় সংস্পর্শে আসা ইঁদুরগুলো এমন শুক্রাণু তৈরি করেছে, যার ডিএনএ ক্ষতিগ্রস্ত এবং গতিশীলতাও কম। এর কারণ হিসেবে গবেষকরা দেখেছেন, অক্সিডেটিভ স্ট্রেস অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে বিপর্যস্ত করে ফেলে। রডেন্ট লেইডিগ কোষ নিয়ে আলাদা এক গবেষণায় দেখা গেছে, ন্যানোপ্লাস্টিকের সংস্পর্শে মাইটোকন্ড্রিয়া সংকুচিত হয়ে পড়ে, ফলে টেস্টোস্টেরনের উৎপাদন কমে যায়। ২০২৪ সালে প্রকাশিত কয়েকটি পর্যালোচনা প্রবন্ধে বলা হয়, মাইক্রোপ্লাস্টিক হাইপোথ্যালামাস পিটুইটারি গোনাডাল অক্ষকে ব্যাহত করতে পারে, ফলে হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট হয় এবং ডিম্বাণু পরিপক্বতা সঠিকভাবে হয় না। কারণ, মানব ডিম্বাণু গঠনে কয়েক মাস সময় লাগে, তাই স্বল্পমেয়াদী নয়, দীর্ঘমেয়াদি প্লাস্টিকের সংস্পর্শই বেশি প্রভাব ফেলতে পারে। ডিম্বাণু ও শুক্রাণুতে প্লাস্টিকের মাত্রা নিয়ে সাম্প্রতিক তথ্য বলছে, পরীক্ষিত ডিম্বাণুর তরলে ৩১ শতাংশ ক্ষেত্রে, আর শুক্রাণুর নমুনায় ৪১ শতাংশ ক্ষেত্রে পিটিএফই পাওয়া গেছে। নারীদের নমুনায় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উপস্থিতি ছিল পলিপ্রোপিলিন। আর পুরুষদের ক্ষেত্রে পলিস্টাইরিন। আরও পাওয়া গেছে পলিইথিলিন টেরিফথ্যালেট। তবে এর সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম।