এক নজরে

কেবল আধার নয় ভাবনা আধেয়

By admin

January 20, 2023

ফেলিনির ছবি দেখার পর দর্শক ও সমালোচকদের অনেকেই তাঁকে বলেছেন তিনি ‘নয়াবাস্তববাদী’, কেউ বলেছেন না, তিনি‘পরাবাস্তববাদী’,আবার এ কথাও বলেছেন কেউকেউ, তাঁর ছবি অতিরঞ্জিত ও অসংযত কিন্তু তিনি দুঃসাহস দেখিয়েছেন। ম্যানুয়েলা জ্যেরি, ফেলিনিকে বলেছেন চলচ্চিত্র লেখক। (কনটেম্পোরারি ইটালিয়ান ফিল্মমেকিং: স্ট্র্যাটেজিস অবসাবভারশন: পিরানদেলো, ফেলিনি, স্কোলা, অ্যান্ড দ্য ডিরেক্টর্স অব দ্য নিউ জেনারেশন) ।কিন্তু কিভাবে ফেলিনি চলচ্চিত্র লেখক হয়ে উঠলেন?

ফেলিনি বেড়ে উঠছেন তাঁর চারপাশের ফ্যাসিবাদের উত্থান, ভিন্ন মতাবলম্বীদের উপর অক্রমন, যুদ্ধ, ভেঙে পড়া অর্থনীতি, তার মধ্যে ধনীদের নির্লজ্জ বিলাসিতা আর উলটো দিকে দয়াহীন দারিদ্র, সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রাম, সব মিলিয়ে বিরাজমান যে মহানৈরাজ্য তার ভেতরেই ফেলিনি আবিষ্কার করছেন জীবনের ছন্দ। হয়তো সে কারণেই তাঁর ছবিতে বিপুল সংখ্যক চরিত্রের ভিড় ঘটিয়ে এক ধরণের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি করে ফেলেন। আমরা তাঁর ছবির ভালোবাসার দৃশ্যেও কিঞ্চিত নৈরাজ্য খুঁজে পাই। কিন্তু এই সবের মধ্যেই তিনি এক অন্তঃমিল ধরতে চান, প্রতিষ্ঠা করেন শৃঙ্খলা।

তাঁর ছবির বেশির ভাগ চরিত্ররাই সরল-জটিল-উদ্ভট-পাগলাটে-বিরল-বিচিত্র। তাদের কারও দেখা মেলে সমুদ্রতটে, হোটেল লবিতে বা বড়লোকী বৈঠকখানায়, বেশ্যালয়ে, কখনো সার্কাস, থিয়েটার ও মঞ্চে,কখনো তারাই আবার লোকারণ্যে জনান্তিকে, কখনো বা ভিড়-ভাট্টায় নিজের সঙ্গে নিজে কথোপকথনে ব্যস্ত। হয়তো ফেলিনি নিজেও ভিড় পছন্দ করতেন। ছবির জন্য চরিত্র বাছাই করবেন বলে প্রচুর লোককে আমন্ত্রণ জানাতেন। কখোনো তাদের মধ্যে থেকেই তিনি পেয়ে যেতেন ছবির জন্য তাঁরভাবনা অনুযায়ী চরিত্র বা পরবর্তী ছবির জন্য কোনও চরিত্রের আভাস। অনেক সময়েই নিজের ছায়া তিনি বসিয়ে দিতেন ছবির চরিত্রের উপর।

ফেলিনির ছবি যারা দেখেছেন তারা জানেন যে তিনি বিশ্বাস করতেন একটি ছবি ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতার স্পষ্ট উপস্থাপন ছাড়াই সামাজিক ও রাজনৈতিক ছবির চেয়ে ঢের বেশি বাস্তববাদী হয়ে উঠতে পারে। তাঁর ছবিতে ধনী আর দরিদ্র মানুষের যেমন দেখা মেলে তেমনইদেখা মেলে ফ্যাসিবাদী শাসক ও শোষিতের, পাশাপাশি উপাসনালয় ও বেশ্যালয়ের। স্মৃতিচারণের মতো করে ফেলিনি এই বিষয়গুলোকে নিয়ে কোলাজ তৈরি করেন, মোটিফ নির্মাণ করেন। তাতে সরাসরি রাজনৈতিক বক্তব্য না থাকলেওকিন্তু কি ভীষণ রকম রাজনৈতিক!

ফেলিনি সার্কাস, সিনেমা ও জীবনকে সমান্তরালে দেখতেন। ফেলিনির নিজের কথা,“সিনেমা অনেকটা সার্কাসের মতো। সিনেমার যদি কোনও অস্তিত্ব না-থাকত, রসেলিনির [রবের্তো রসেলিনি চলচ্চিত্র পরিচালক ও ফেলিনির গুরু] সঙ্গে যদি আমার দেখা না-হত, আর যদি সার্কাসের আজও একটা সমকালীন কার্যকারীতা থাকত, আমি তা হলে একটা বড় সার্কাসের পরিচালক হতে পারলে বেশি খুশি হতাম”।

চলচ্চিত্রে অসংখ্য বিচিত্র চরিত্রগুলো যেন ফেলিনিরই জীবন থেকেই উঠে আসা কারও না কারো সিনেম্যাটিক মেটামরফোসিস। প্রতিটি ছবিতে এতো এতো চরিত্র, ছোট-মাঝারি-বড়, নিয়ে কাজ করা যে কোনও পরিচালকের জন্যই কঠিন ব্যাপার, কিন্তু কাজটি তিনি বেশ অনায়াসেই করে গিয়েছেন আজীবন। চিত্রনাট্যের অধিকাংশই কাগজে নয়, থাকতো তাঁর মাথায়। আর সংলাপ? সেটা কখনো হতো তাৎক্ষণিক, আবার কখনো বা তিনি শিল্পীদের ক্যামেরার সামনে বলতেন প্রার্থনা করতে, নামতা আওড়াতে বা কোন ছড়া বলতে। ডাবিং করার সময় শিল্পীর ঠোঁটে তিনি বসিয়ে দিতেন যুৎসই সংলাপ। এই ভাবে সিনেমা বানানো একমাত্র তার পক্ষেই সম্ভব, যার মাধ্যমটির উপর অসম্ভব দখল রয়েছে।