এক নজরে

GuptiPara Rathyatra : গুপ্তিপাড়ার ইতিহাস ও তার ঐতিহাসিক রথযাত্রার পটভূমি

By admin

July 09, 2022

১৭৭৯ সালে জেমস রেনেলের ম্যাপ থেকে জানা যায় বেহুলা নদী গুপ্তিপাড়ার পাশ দিয়ে বয়ে চলে ; এমনিতে ভাগীরথী নদীর তীরে অবস্থিত গুপ্তিপাড়া । বর্ধমান-হুগলী জেলার মধ্যবর্তী একটি স্থান গুপ্তিপাড়া । শুধু গুপ্তিপাড়ার রথেই (GuptiPara Rathyatra) ইতিহাসের আস্তরন লেগে নেই ; গুপ্তিপাড়া স্থানটিও নিজস্ব ঐতিহাসিক মহিমায় উজ্জ্বল । এখনকার দূর্গাপূজা থেকে শুরু করে রথ সবতেই ইতিহাস তার ছাপ রেখেছে। বাংলার প্রথম ‘বারোয়ারি দূর্গাপুজো’র প্রচলন হয় গুপ্তিপাড়াতেই । এখনো সেখানে বিন্ধ্যবাসিনী মন্দিরে সেই ঐতিহাসিক দূৃর্গাপুজো পালিত হয় । কথিত আছে সেনদের বাড়ির দূর্গাপুজোতে অংশগ্রহণ না করে ১২ জন ব্রাহ্মণ গুপ্তিপাড়াতে প্রথম বারোয়ারি দূর্গাপুজো শুরু করেছিলেন। সেই থেকেই বারোয়ারি দূর্গাপুজো নাম এসেছে।এবার আসি এখানের আরকটি বিখ্যাত ঐতিহাসিক বিষয়ে , তা হল গুপ্তিপাড়ার রথযাত্রা (GuptiPara Rathyatra)।

চিত্র গৌর শর্মা।

২৭৯ বছরের প্রাচীন বৃন্দাবনচন্দ্রের রথযাত্রা শুরু হয় রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সময়ে। বৃন্দাবন মঠের সামনে থেকে বাজার পর্যন্ত দীর্ঘ এক মাইল পথের দু’ ধারে মেলা বসে। এখানের রথে চেপে থাকেন জগন্নাথ নামধারী কৃষ্ণ নন ,এখানের রথের মূল আকর্ষণ বৃন্দাবনচন্দ্র জিউর । যদিও যিনি কৃষ্ণ তিনিই জগন্নাথ আবার কোথাও আঞ্চলিক ভাষায় তিনিই আবার বৃন্দাবনচন্দ্র। গুপ্তিপাড়ার রথের একটি ভিন্ন আঙ্গিক বা প্রথা হল – ‘ভান্ডারালুঠ’। উল্টোরথের আগের দিন এই প্রথা বা উৎসব পালন করা হয় । ভাণ্ডারা লুটের পেছনে একটা গল্প আছে।একবার মা লক্ষ্মীর সঙ্গে মন কষাকষি হওয়ায় প্রভু জগন্নাথ লুকিয়ে মাসির বাড়িতে আশ্রয় নেন। মা লক্ষ্মী ভাবলেন, স্বামী বোধহয় পরকীয়ায় জড়িয়েছেন । শ্রী বৃন্দাবনের কাছে জানতে পারলেন প্রভু জগন্নাথ রয়েছেন মাসির বাড়িতে। স্বামীর মতিস্থির করাতে লক্ষ্মী লুকিয়ে ওই বাড়িতে ‘সর্ষে পোড়া ছিটিয়ে আসেন, পরে জানতে পারেন মাসির বাড়ির উপাদেয় খাদ্য সমুহের জন্যেই প্রভু জগন্নাথ নাকি আসতে পারছেন না। তখন মা লক্ষ্মীর অনুরোধে শ্রী বৃন্দাবন লোকলস্কর নিয়ে যান মাসির বাড়ি, গিয়ে দেখেন, তিনটি দরজাই বন্ধ। দরজা ভেঙে ভিতরে ঢুকে তাঁরা সারি সারি মালসার খাবার লুঠ করে নেন, শেষে প্রভু জগন্নাথ মনের দুঃখে মা লক্ষ্মীর কাছে ফিরে আসেন। এই গল্প অনুসারে উল্টোরথের আগের দিন ভান্ডারা লুঠ হয় । প্রায় ৫২ রকমের ভোগ সাজিয়ে রাখা হয় মন্দিরে গর্ভগৃহে তারপর দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয় , পরে ভক্তরা দরজা খুলে সেই ভোগ লুঠ করেন -এইটি হল ভান্ডারা লুঠ। ভোগের মধ্যে থাকে জগন্নাথের পছন্দের সব খাবার যেমন গোবিন্দভোগ খিচুড়ি , ছানার রসা, রাবরি , আরো অনেক কিছু । তাই যদি গুপ্তিপাড়ার রথ ভান্ডারা লুঠ উপভোগ করেতে হয় তাহলে উল্টোরথের আগের দিন সেখানে যাওয়া উচিত ।

চিত্র গৌর শর্মা।

চিত্র গৌর শর্মা।

চিত্র গৌর শর্মা।

চিত্র গৌর শর্মা।

গুপ্তিপাড়ায় রয়েছে মঠ;মঠে রয়েছে ৪টি বৈষ্ণব মন্দির। বৃন্দাবনচন্দ্র, চৈতন্য, রামচন্দ্র এবং কৃষ্ণচন্দ্রের মন্দির। রামচন্দ্র মন্দিরে বাংলার টেরেকোটা স্থাপত্যের নিদর্শন আছে। এই চার মন্দিরের সমষ্টিকে বলা হয় গুপ্তিপাড়ার মঠ। এ মঠগুলি তারকেশ্বর মন্দিরের অধীনে , অর্থাৎ শৈব মন্দিরের অধীনে বৈষ্ণব মন্দির ,-এর পেছনেও হয়তো ঐতিহাসিক পটভূমি আছে। এছাড়া বৃন্দাবনমঠের নিকট প্রাচীন দেশকালী মাতার মন্দির আছে। দেশকালীমাতা গুপ্তিপাড়ার অধিষ্ঠাত্রী দেবী। কালীপূজার দিন নতুন মাটির মূর্তি এনে পুজো করা হয়। পরের শুক্লা দ্বিতীয়ার দিন মূর্তির কেশ, কাঁকন, কেউর, কপোল প্রভৃতি কেটে নিয়ে বাকি মূর্তি গঙ্গায় বিসর্জন দেওয়া হয়। খণ্ডিত অংশগুলো একটা আধারে রেখে সারা বছর তান্ত্রিক মতে পূজা করা হয়। এই মন্দিরে আধার ছাড়া কোনো দেবীমূর্তি নেই।

গুপ্তিপাড়ার নামকরন নিয়েও বেশকিছু ইতিহাস ও কাহিনীর সমাহার রয়েছে । বলা হয় এক সময় ব্রাহ্মণ আর বৈদ্যদের গুপ্ত সাধনার স্থান ছিল এই জায়গা তাই নাম গুপ্তিপাড়া ,যদি এ তথ্য সঠিক নয়, তবে একসময় বাংলার তন্ত্র সাধনার অন্যতম পীঠস্থান গুপ্তিপাড়া । তবে তথ্যনির্ভর আরেকটি মত হল এক সময় এ অঞ্চল নদীর নীচে গুপ্ত ছিল পরে নদীর গতিপথ পরিবর্তন হওয়াই এ স্থান উঠে আসে। তাই থেকে গুপ্তিপাড়া । গুপ্তিপাড়ার সেনবাড়ির বনেদী দূর্গাপুজোই একটি চমক হল এখানে লক্ষ্মীর বাহন পেঁচা জ্যান্ত । এ জ্যান্ত পেঁচা সারাবছর পালিত হয় ।