তাঁর প্রথম ছবি ‘জীবন নাইয়া’ মুক্তির খবর খান্ডোয়ার বাড়িতে পৌঁছতেই হুলুস্থুল বেঁধে গেল। তার সঙ্গে বিয়েটাও গেল ভেঙে। তাঁর মা এই ঘটনায় মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়লেন। বাবা ফতোয়া জারি করে দিলেন, তাঁকে অভিনয় ছেড়ে চাকরি করতে হবে। তাতেও মন সন্তুষ্ট হল না, ছেলের মতি ফেরাতে সোজা পৌঁছে গেলেন নাগপুর তাঁর কলেজের বন্ধু মুখ্যমন্ত্রী রবিশঙ্কর শুক্লার কাছে। সবিস্তারে ছেলের সব কথা জানিয়ে ছেলের জন্য একটি চাকরির আবদার করলেন। নাগপুরের মুখ্যমন্ত্রী তাঁর বাবাকে হতাশ করেননি। বন্ধুর ছেলের জন্য একটি নয় দু’টি চাকরির প্রস্তাব দেন। যার মধ্যে একটি ছিল, আয়কর দফতরের অধিকর্তার পদ। মাইনে তখনকার দিনে ২৫০ টাকা! এরপরেই তাঁর বাবার কড়া নির্দেশ, অভিনয় ছেড়ে যে কোনও একটি চাকরি বেছে নিতে হবে। দোটানায় পড়ে গেলেন তিনি। না পারছেন অভিনয় ছাড়তে, না অস্বীকার করতে পারছেন স্বাভাবিক জীবনের হাতছানি!
তিনি যে নিজেও অভিনয় করতে চেয়েছিলেন তাও নয়। সিনেমার স্বপ্ন ছিল তবে চেয়েছিলেন ছবি পরিচালনা করবেন। কারণটা তিনি নিজেই জানিয়েছিলেন, সেই সময়ে সবাই মনে করতেন যৌনকর্মীরাই রুপোলি পর্দায় নায়িকা হন। আর নায়ক হন দালালেরা। অথচ একদিন তিনি রাস্তায় বেরোলে; তখন তিনি সিনেমার নামকরা হিরো, মুম্বাইয়ের রাস্তা যানজটে আটকা পড়তো শুধু মাত্র তাঁর অনুরাগীদের ভিড়ে। পৃথ্বীরাজ কপূরের বড় ছেলের বিয়েতে ঢুকলেন বম্বে টকিজ়ের এক নম্বর স্টার অশোককুমার। তাঁকে দেখামাত্র নতুন বউ কৃষ্ণা রাজ কপূর ঘোমটা সরিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘‘আরে, অশোককুমার!’’ তার পরে রাজ্যের অপরিচিত অভ্যাগত, রাজনীতির সব কেষ্টবিষ্টুদের দিকে তাকিয়ে ভারী উত্তেজিত ভাবে বলতে থাকলেন, ‘‘আমি ‘কিসমত’ তিন বার দেখেছি। আর ‘অচ্ছুৎ কন্যা’ আমার দেখা প্রথম ফিল্ম।’’ অশোককুমার তখন হোহো করে হাসছেন। পৃথ্বীরাজ কপূর কী ভাবে বরকর্তাসুলভ গাম্ভীর্য ধরে রাখবেন, ভেবে পাচ্ছেন না। আর স্বয়ং বর রাজ কিংকর্তব্যবিমূঢ়।
তাহলে কিভাবে অসম্ভবকে সম্ভব করে সর্বভারতীয় ছবির দুনিয়ায় তিনি জায়গা করে নিয়েছিলেন? ঠিক এইসময়েই ভারতীয় সিনেমা দুনিয়ায় একটি সাড়াজাগানো ঘটনা ঘটে। তাকে স্ক্যান্ডালও বলা যায়। পুরোদমে চলছে ছবির শ্যুটিং, বেপাত্তা ছবির নায়ক নায়িকা। তাঁদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। প্রযোজকের মাথায় হাত, বুকেও ব্যাথা। কারণ নায়িকা প্রযোজকের স্ত্রী। অর্ধেক শ্যুটিং হয়ে যাওয়া ছবির কাজ থামিয়ে বোম্বে টকিজের কর্ণধার হতাশায় ভেঙে পড়েলেন। স্ত্রীর এভাবে চলে যাওয়াটা তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না। কোথায় গেলেন দেবিকারানি আর নাজমুল হাসান? এই জুটির প্রথম ছবি ‘জবানি কি হাওয়া’ বাণিজ্যিকভাবে সফল হওয়ায় হিমাংশু রায় পরের ছবিও ওঁদের নিয়েই শুরু করেছিলেন। ইতিমধ্যে তাঁদের যে মন দেওয়া নেওয়া চলছে সে কথা কেউ টের পায়নি। আচমকা তাঁরা উধাও হয়ে গেলেন। অবশেষে কলকাতায় তাদের খোঁজ মিললো। বুঝিয়ে সুঝিয়ে দেবিকারানিকে বম্বে ফিরিয়ে আনা হল কিন্তু নাজমুল ফিরিলেন না।
ফের শুরু হবে ছবির কাজ। নাজমুলের সব শট ফেলে দেওয়া হল। নায়িকা দেবিকারানি অপরিবর্তিত রইলেন কিন্তু রেডি নায়ক কোথায় মিলবে? স্টুডিওতে হিমাংশু রায়ের নজর কাড়লো তাঁরই ল্যাবরেটরি অ্যাসিস্ট্যান্ট-এর চেহারা। খোঁজ নিয়ে জানা গেল ছেলেটি সাউন্ড রেকর্ডিস্ট শশধর মুখার্জির শ্যালক। কিন্তু অভিনয়ে মোটেই আগ্রহ নেই তাঁর। তার ওপর সেই সময়ে তাঁর বিয়ের কথাবার্তা চলছে, এই সময় সিনেমায় মুখ দেখালে বিয়ে যাবে ভেঙে। অবশেষে তাঁকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে রাজি করানো হল। কিন্তু যাতে তাঁকে বাতিল করা হয় তার জন্য সে শ্যুটিঙের দিন মাথা ন্যাড়া করে ফ্লোরে হাজির হল। ছাড়ার পাত্র নয় হিমাংশু রায়, দেবিকারানি ছেলেটির মাথায় উইগ পরিয়ে দিতে বললেন। ক্যামেরার সামনে মোটেও স্বচ্ছন্দ বোধ করেন নি, কিন্তু উতরে গেল বম্বে টকিজের ‘জীবন নইয়া’।
স্বভাবতই বম্বে টকিজের পরের ছবিতে তাঁকেই নায়ক করা হল। এবার তিনি ব্রাহ্মণসন্তান প্রতাপের ভূমিকায় আর দেবিকারানি অস্পৃশ্য হরিজন কন্যা কস্তুরি। এঁদের দুজনের প্রেম, সমাজ মেনে নিতে পারে না, বিরোধ বাধে, বহু সঙ্কটের মধ্যে শেষমেশ কস্তুরীর আত্মবলিদানে বাঁচে প্রতাপ। হিন্দি ভাষায় তোলা বম্বে টকিজের ‘অচ্ছুতকন্যা’ ভারতীয় সিনেমার মাইলস্টোন একাধিক কারণে। সেই সঙ্গে অভিনয়ে অনাগ্রহী কুমুদলাল গঙ্গোপাধ্যায় পরবর্তীতে অশোক কুমার নিজেকে কিংবদন্তিতে পরিণত করেছিলেন।
‘বচন’-এ রাজপুত শৌর্য, ‘ইজ্জত’-এ দেশি রোমিওর ভূমিকায় তিনি সকলের নজর কাড়লেন। কিন্তু তিনি মানুষ হিসেবে বেশ বিচিত্রবর্ণের, বিভিন্ন ধরনের চরিত্রে অভিনয় করাটাই ছিল তাঁর পছন্দ। হিমাংশু রায়ের মৃত্যুর পরে বম্বে টকিজ়ের যখন ঘোর দুর্দিন, তখন শশধরমুখার্জি, জ্ঞান মুখোপাধ্যায় আর অশোককুমার একসঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করলেন, একঘেয়ে প্রেমের গল্প দিয়ে আর সিনেমা বানানো ঠিক হবে না। চার দিকে যুদ্ধ, দুঃসময়, নৈরাজ্যের মধ্যে কতরকমের ঘটনা আর মানুষ সেসব নিয়েই চিত্রনাট্য লিখতে হবে। কয়েকটা বিদেশি ছবির অনুপ্রেরণায় নতুন ধরনের কাহিনি ভাবলেন তাঁরা। সেই ভাবনাতেই তৈরি হল ‘কিসমত’। মুখ্য চরিত্র আড়চোখে লোককে দ্যাখে, ঠকায়, দাঁতে সিগার চেপে ধোঁয়া ছাড়ে। নিজেই বুঝলেন নায়ক ছাড়াও খলনায়ক হিসেবেও অভিনয়েও তিনি সাবলীল। ১৯৪৩ সালে মুক্তি পাওয়া এই ছকভাঙা ছবিটি দীর্ঘদিন ভারতের সফলতম ছবি ছিল। পরে সে রেকর্ড ভাঙে ‘শোলে’। ক্রিপ করা ব্যাকব্রাশ চুল, আংরেজ পাতলুন, আঙুলের ফাঁকে সিগারেটে ছেলেদের তখন দাদামণি সাজার কী ধুম! এই লেডিকিলার লুক আর ক্যারেক্টারে পরেও অশোককুমারকে পর্দায় দেখা গিয়েছে, ‘হাওড়া ব্রিজ’, ‘ভাই ভাই’ ইত্যাদি ছবিতে, আবার পুরোদস্তুর ভিলেন হয়ে মাত করেছেন ‘জুয়েল থিফ’-এ।
2 Comments
হিন্দি চলচ্চিত্রাঙ্গণে স্বভাবসুলভ অভিনয় করে পথিকৃৎ হয়ে রয়েছেন অশোক কুমার। প্রথম মহাতারকা হিসেবে খলনায়ক চরিত্রেও অভিনয় করেছেন তিনি। ভারতীয় চলচ্চিত্রে বেশকিছুসংখ্যক তারকা ব্যক্তিত্বের প্রতিষ্ঠা লাভে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। বোম্বে টকিজের পরিচালক হিসেবে ১৯৪৮ সালে দেব আনন্দকে প্রথমবারের মতো জিদ্দি চলচ্চিত্রে অংশগ্রহণ করান। এছাড়াও, দেশ বিভাজনের পর ভারতে চলে আসা অভিনেতা প্রাণকে ঐ সময়ের সফলতম খলনায়ক হিসেবে পুনর্বাসন ঘটান।
কথিত জওহরলাল, তার মেয়ে ইন্দিরা ও সরজিনি নাইডু ‘অচ্ছুতকন্যা’ দেখতে এসেছিলেন। সরজিনী নাকি গানের সময় জানতে চেয়েছিলেন এই ছেলেটি কে? বড় ভাল গাইছে তো…!