ঘুরে-ট্যুরে

মানস ভ্রমণ নয়, মানসে ভ্রমণ

By admin

October 06, 2020

সময়টা ছিল জুন মাসের মাঝামাঝি।খাতায় কলমে বর্ষা এলেও, বৃষ্টি সেভাবে নামেনি। গুয়াহাটি থেকে বরপেটা হয়ে যখন মানস জাতীয় উদ্যানের কাছে পৌঁছালাম, তখন বেলা প্রায় বারোটা। গুয়াহাটি থেকে বরপেটা পর্যন্ত ট্রেন এবং বাস যোগাযোগের যথেষ্ট ভালোই যোগাযোগ রয়েছে। কিন্তু আমরা গাড়িতে যাবো ঠিক থাকায় সকালে ধীরে সুস্থে ব্রেকফাস্ট সেরেই বেরোলাম। এসি গাড়ি থাকায় রাস্তায় গরমটা মালুম হলো না। বরপেটা পর্যন্ত রাস্তাও বেশ মসৃণ। যদিও বারপেটার পর থেকে মানসের দিকে যাওয়ার রাস্তাটি ছিলো বেশ খারাপ।

মানস জাতীয় উদ্যানের বাইরে বিরিনা ইকো রিসোর্টে নেমেই মালুম হলো, বাইরে ঠিক কতটা গরম। বুকিং আগে থেকেই করা ছিলো।মালপত্র নামাতে এগিয়ে এলেন রিসোর্টের কর্মচারী। ম্যানেজার আপ্যায়ন জানালেন, রিসেপশনে অল্প কিছুক্ষন অপেক্ষা করতে। বললেন, আপনাদের ঘর রেডি করাই আছে। মালপত্রও ঘরে পাঠিয়ে দিচ্ছি। দেখলাম, সামান্য দুই একটি কথার মধ্যেই এলো ঠান্ডা নরম পানীয়। খেতে খেতে যেন শরীরটা জুড়িয়ে এলো। ভালো করে দেখলাম, কাঠের পুরানো বাংলো। সেটাই এখন রিসেপশন। ম্যানেজার জানালেন, ব্রিটিশ আমলে এটাই ছিলো চা বাগানের ম্যানেজারের বাংলো। দেখলাম, সামনে, বাঁয়ে চা বাগান। ডাইনে আর পেছনের দিকে বেশ কিছু বড় গাছের জঙ্গল।

রিসর্টের কর্মচারী এসে আমাদের ঘরে নিয়ে গেলো। ঘরটা পছন্দ হলো সবারই। বাচ্চা থেকে বয়স্ক মিলিয়ে আমরা ছিলাম ৫ জন। সাড়ে চার জন বলাই ভালো। কটেজের ঘরটা বেশ বড়। আলাদা আলাদা খাটের সবগুলিই বেতে বোনা। ঘরের চেয়ার, টেবিলগুলিও সবই বেতের। টয়লেট টিও বেশ প্রশস্ত এবং ঝাঁ চকচকে। সামনেই ওয়ার্ডরোব। বারান্দাটিও বেশ চওড়া। সেখানে সাজানো চেয়ার, টেবিলগুলিও সবই বেতের। সামনেই বাগান। সেখানে গাছে ঝুলছে বেতের টুকরি। ওগুলো ওয়েস্টবিন। গোটা চত্বরে কোথাও সামান্য অবর্জনাও চোখে পড়লো না।

বেলাও গড়াচ্ছে। এতগুলো মানুষের স্নান সারতেও সময় লাগবে। খিদেও পাচ্ছে। এর মধ্যেই এলো এক রাউন্ড চা। কেউ চা খাচ্ছে, কেউ স্নান সারছে। দুপুরে সবাই হাজির হলাম ডাইনিং টেবিলে। হাসি মুখে স্বাগত জানালেন ম্যানেজার। গরম ভাত, ডাল, গরম গরম বেগুন ভাজা, স্যালাড,আলু ঢেরসের চচ্চড়ি, মুরগির হালকা কিন্তু অপূর্ব ঝোল, আমের টক। খেয়ে সত্যিই মনে হচ্ছিলো যেন বাড়ির খাবারই খাচ্ছি। খাওয়ার পর সবারই যেন দুচোখের পাতা জুড়ে আসছে। কিন্তু ম্যানেজার বললেন, ঘন্টা খানেক রেস্ট নিয়ে আপনারা বরং আজ বিকেলেই মানসে জঙ্গল সাফারিটা সেরে নিন। এখন বর্ষা কাল। কখন কি রকম পরিস্থিতি থাকে বলা যায় না। আকাশটা ভালোই আছে। কাল যদি কোনো কারণে ভোরবেলা কিংবা বিকেলে বৃষ্টি হয়, তবে হুড খোলা জিপে জঙ্গল সাফারি করতে পারবেন না।

রোদের তেজ একটু কমতেই রিসোর্টে হাজির হলো জঙ্গল সাফারির গাড়ি। একখানা হুড খোলা মারুতি জিপসি। আগে জিপসি গাড়ি দেখা গেলেও এখন সেনাবাহিনী আর পাহাড় ছাড়া সেভাবে দেখাই যায় না। চিন্তা ছিলো দিদাকে নিয়েই। কারণ বয়স হয়েছে। জিপসির পেছন দিকে উঠতে হলে খানিকটা উঁচুতে উঠতে হয়। দেখলাম, দিদাও বেশ ইতস্তত করছে। আর বলছে, আমি কি পারবো এতটা উঠতে! কিন্তু সমস্যা সমাধানে এগিয়ে এলেন রিসোর্টের ম্যানেজার। বললেন, আপনি কিছু চিন্তা করবেন না। আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। গাড়ির পেছন দিকে পাতা হলো দুটি পিড়ি। একটা বড়, একটা একটু ছোট। হাত ধরে সেটার ওপর চাপিয়েই গাড়িতে তোলা হলো দিদাকে। পড়ন্ত বেলার নরম আলোয় ম্যানেজার বলে দিলেন, কিচ্ছু চিন্তা নেই। ফেরার সময়েও এভাবেই নামিয়ে নেব। সঙ্গে থাকছে আমাদের রিসোর্টের লোক। থাকবে ফরেস্টের গাইড ও। রিসোর্ট থেকে মানস জাতীয় উদ্যানের প্রবেশ দ্বার বড়জোর দেড় কিলোমিটার। দুপাশে চা বাগান। মাঝে মধ্যে শাল, সেগুনের জঙ্গল। কয়েকটি গ্রাম। টিনের চালার বাড়ি। যেমন উত্তরবঙ্গের গ্রামগুলিতেও দেখা যায়। মানসের গেটে পাস ইস্যু করার পর গাড়িতে সঙ্গে দেওয়া হলো বন্দুকধারী একজন বনরক্ষী। জঙ্গলের মধ্যে নুড়ি, পাথর বিছানো পথে চলতে শুরু করলো গাড়ি।

জঙ্গলে ঢুকতেই মনটা খানিক খারাপ হয়ে গেল। কোথায় জঙ্গল? এতো উঁচু ঘাসের জঙ্গল। বক্সা, জলদাপাড়া, চাপরামারী, চিলাপাতার মতো গভীর জঙ্গল কোথায়? বনরক্ষী বললেন, এই ধরণের ঘাসের ঝোপই জঙ্গলের পশুদের বেশি পছন্দ। কখনো পাতলা হচ্ছে ঘাসের জঙ্গল, গাঢ় হচ্ছে গভীর বন। বিকেল গড়াচ্ছে। বাসায় ফিরছে নাম না জানা বহু ধরণের পাখি। দেখা মিললো কিছু হনুমানের। গভীর জঙ্গলের সামনে গিয়ে গাড়িটা হঠাৎ স্লো হয়ে গেল। ফরেস্ট গার্ড আঙ্গুল তুলে দেখালেন বাম দিকে। দেখা গেলো, ৩০ মিটার দূরে জঙ্গলের মধ্যে দাঁড়িয়ে রয়েছে এক দল বাইসন। সরাসরি তাকিয়ে রয়েছে আমাদের দিকেই। বেশিক্ষণ তাদের বিরক্তির কারণ না হয়ে গাড়ি এগিয়ে চললো সামনের দিকে। খানিক বাদে ফের শুরু হলো ঘাসের জঙ্গল। দেখা গেলো, সেখানে বিচরণ করছে তিনটি হাতি। মাটির রাস্তা পেরিয়ে গিয়ে সেই ঘাসের জঙ্গলেই ঢুকলো একটি গন্ডার। এমন আরো কিছু অভিজ্ঞতা হলো সেখানে। ফরেস্ট গার্ড মাঝে মধ্যে গাড়ি দাঁড় করিয়ে নিয়ে গেলো ওয়াচ টাওয়ারগুলিতে। কোনোটা ট্যুরিস্টদের জন্য। কোনোটা ফরেস্ট গার্ডদের জন্য। দেখতে দেখতে সন্ধ্যা নেমে এলো। ঘন্টা তিনেকের বেশি জঙ্গল সাফারি সেরে আমরা ফিরলাম রিসোর্টে।

ম্যানেজার ঠিকই বলেছিলেন। আকাশ কখন কেমন হয় বলা যায় না। সন্ধ্যায় রিসোর্টে ফেরার পরেই নামলো বৃষ্টি। প্রথমে টিপটাপ , পরে ঝমঝমিয়ে। বারান্দায় এসে বসলাম আমরা। বলাই ছিলো, এলো চা আর পাকোড়া। ছাতা মাথায় তা দিয়ে গেলো রিসোর্টের কর্মী। আড্ডায় যোগ দিলেন ম্যানেজার ও। গল্পে গল্পে বলছিলেন, কিভাবে গত কয়েক বছরে ওই গ্রাম এবং তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় কিভাবে অন্তত তিনজন মানুষের প্রাণ গিয়েছে, হয় বাইসন না হয় চিতা বাঘের কারণে। শুনে খানিকটা ভয়ও যে হচ্ছিলো না তা নয়। আশেপাশের টিনের চালের ঘরগুলোতে তখন চলছে বাদলের ধারাপাত।

গিয়েছিলাম মামাদের সঙ্গে। মানে মামা, মামি, ছোট্ট মামাতো ভাই আর দিদার সঙ্গে। আমার মামাটা একটু মেছো প্রকৃতির। যেখানেই যাক না কেন, তার মাছ লাগে। ভাইয়ের পছন্দ মাংস। আমিও ভাইয়ের দলেই। মামা চেয়েছিলো রাতেই মাছের ব্যবস্থা করতে। ম্যানেজার সাহেব বললেন, বিকেলের দিকে এখানে তেমন ভালো মাছ পাওয়া যায় না। কাল খাওয়াবো নদীর স্থানীয় মাছ। আপনিও চলুন আমার সঙ্গে। ঘুরে দেখবেন লোকাল বাজারটা। তাই ঠিক হলো। ডিনারে ছিলো ডিম কষা, ডাল, ভাজা, সালাম। সঙ্গে ডাল বা রুটি।

পরদিন বাইরে তেমন কোথাও যাওয়ার ছিলো না।ঘুরলাম সামনের চা বাগানে। কথা বললাম স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে। ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের স্বীকৃতি পাওয়া মানস জাতীয় উদ্যানে রয়েছে তিনটি এলাকা। বাঁশবাড়ি,পানবাড়ি ও পাঠশালা। মূল এলাকাটি অবশ্য বাঁশবাড়িতেই। সেখানেই আমরা ছিলাম। সকালেই ব্রেকফাস্ট সারা হয়ে গিয়েছিলো। রীতিমতো বিদেশি কায়দায়। সত্যি বলতে কি, বাড়িতে এতটা অভ্যস্ত নই অনেকেই। ব্রেড, বাটার, ফিঙ্গার চিপস, জ্যাম, অমলেট, ডিম সেদ্ধ, ফ্রুট জুস। সকালে চা,বিস্কুট তো ছিলোই। দুপুরে এলো নদীর টাটকা ছোটো মাছের ঝোল। সঙ্গে বাকি যা থাকার তো ছিলোই। সন্ধ্যাটা ছিলো আমাদের মেঘালয় এবং অসম সফরের শেষ রাত আড্ডা মারলাম নিজেরাই।

পরদিন সকালে পুরি, সব্জি,ফ্রুট জুস খেয়ে রওনা হলাম আলিপুরদুয়ারের উদ্দেশে।