রুশদির বই ‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’-এর জন্য তাঁকে আত্মগোপন করে থাকতে হয়েছিল। বইটির কারণে বিশ্বজুড়ে মুসলিম সমাযে ব্যাপক ক্ষোভের জন্ম হয়। তারা মনে করেন রুশদির ‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’ বইতে মুসলিম ধর্মের অবমাননা করা হয়েছে। রুশদি বলেছিলেন, বইটি তিনি মহানবি (সাঃ) এর জীবন থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে লিখেছেন৷ কিন্তু বইয়ের কিছু অংশে মহানবি (সাঃ) কে অবমাননা করা হয়েছে বলে মনে করেন অনেক মুসলমান৷ বহু দেশেই বইটি নিষিদ্ধ করা হয়।উল্লেখ্য, বইটি প্রথম নিষিদ্ধ হয় তার জন্মস্থান ভারতে। এরপর পাকিস্তানে নিষিদ্ধ করে সালমান রুশদির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়। এরপর অন্য মুসলিম দেশ ও দক্ষিণ আফ্রিকায় বইটি নিষিদ্ধ করা হয়। কেবল লেখক রুশদি নন, ১৯৯১ সালে বইটির অনুবাদকারী একজন জাপানির ওপরেও হামলা হয়েছিল। এর কয়েক মাস করে একজন ইটালীয় অনুবাদকারীও হামলার শিকার হয়েছেন। গুলি করা হয়েছিলো বইটির নরওয়েজিয়ান প্রকাশককেও। এছাড়া রুশদী বিরোধী দাঙ্গায় নিহত হয়েছেন বেশ কয়েকজন। হামলা হয়েছিল তেহরানে ব্রিটিশ দূতাবাসেও।
১৯৮৯ সালের জানুয়ারিতে ব্রাডফোর্ডের মুসলিমরা প্রথমে বইটির একটি কপিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। এছাড়া একটি দোকানের তাক থেকে বইটি নামিয়ে ফেলতে বাধ্য করা হয়। একই বছর ফেব্রুয়ারি মাসে রুশদির নিজের শহর মুম্বাইয়ে রুশদি বিরোধী দাঙ্গায় ১২ জন নিহত হন। তেহরানে লেখক রুশদির মাথার মূল্য নির্ধারণ করা হয় ২০ লাখ মার্কিন ডলার। ২০০৭ সালে ব্রিটেনে রুশদিকে যখন নাইটহুড দেওয়া হয় তা নিয়েও ইরান ও পাকিস্তানে প্রবল প্রতিবাদ হয়। একজন মন্ত্রী বলেছিলেন যে ‘এই সম্মান আত্মঘাতী হামলাকে বৈধতা দেয়’।
বিশ্বজুড়েই এভাবে সাহিত্যিকদের কলম থামিয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে৷ যৌনতার অভিযোগে জেসম জয়েসের ‘ইউলিসিস’ প্রকাশ হওয়া মাত্র নিষিদ্ধ হয়েছিল৷ জর্জ অরওয়েলের ‘এনিম্যাল ফার্ম’ ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ায় নিষিদ্ধ ছিল৷ ড্যান ব্রাউনের ‘দ্য ভিঞ্চি কোড’ ২০০৩ সালে লেবাননে নিষিদ্ধ করা হয়৷ বোরিস পেস্টারনেকের উপন্যাস ‘ডক্টর জিভাগো’ দীর্ঘকাল নিষিদ্ধ ছিল সোভিয়েত রাশিয়ায়৷ আলেকজান্ডার কাম্পবেলের কল্পকাহিনী ‘দ্য হার্ট অফ ইন্ডিয়া’ ১৯৫৮ সালে ভারতে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল৷ টেড ডাভের ‘ইনটু দ্য রিভার’ বইটি ২০১২ সালে নিউজিল্যান্ডে নিষিদ্ধ করা হয়৷
বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয় না ঠিকই কিন্তু বই লিখে অনেককে দেশ ছাড়া হতে হয়েছে। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের ‘দৈনিক সংবাদ’ এর সাহিত্য পাতায় দাউদ হায়দারের ‘কালো সূর্যের কালো জ্যোৎস্নায় কালো বন্যায়’ নামে একটি কবিতা প্রকাশিত হওয়ার পর ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগ তুলে এক শিক্ষক তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করেন৷ এরপর তাকে নেওয়া হয় নিরাপত্তা হেফাজতে, পরবর্তীতে তাঁকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়৷ সেই থেকে নির্বাসিত আছেন তিনি৷ বাংলাদেশে সরকারের পালা বদল হয়েছে বহুবার, কিন্তু দাউদ হায়দারের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি৷ তিনি নির্বাসিতই থেকে গেছেন, একবারের জন্যও পা রাখতে পারেননি দেশের মাটিতে৷ তসলিমা নাসরিনের বই ‘লজ্জা’ নিষিদ্ধ হয়৷ ওই বইয়ের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ, মিছিল-মিটিং, নামে-বেনামে হত্যার হুমকি এমনকি লেখিকার মাথার দাম পর্যন্ত ঘোষণা হয়৷ এখনও তিনি একরকম নির্বাসিত জীবনই কাটাচ্ছেন৷
অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের বই ‘নারী’ বাংলাদেশে নিষিদ্ধ হয় ১৯৯৫ সালে, ২০০০ সাল পর্যন্ত ওই নিষেধাজ্ঞা জারি ছিল৷ মৌলবাদের বিরুদ্ধে ২০০৪ সালে প্রকাশিত তাঁর উপন্যাস ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’ বাংলাদেশের একটি শ্রেণীকে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ করেছিল৷ ওই বছর ফেব্রুয়ারি মাসে বইমেলা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ফেরার সময় দুর্বৃত্তের ধারালো অস্ত্রের কোপ তাঁকে মৃত্যুর মুখ পর্যন্ত টেনে নিয়ে গিয়েছিল৷ যদিও চিকিৎসকদের চেষ্টায় শেষ পর্যন্ত প্রাণে রক্ষা পান তিনি৷ অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ প্রাণে বেঁচে গেলেও মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা ও লেখক অভিজিৎ রায় ২০১৫ সালে বই মেলায় যোগ দিতে স্ত্রীকে নিয়ে আমেরিকা থেকে ঢাকায় এসেছিলেন। ২৬ ফেব্রুয়ারি রাতে তিনিও বইমেলা থেকে যখন ফিরছিলেন তখন হামলাকারীরা তাঁকে রাস্তায় এলোপাতাড়ি কুপিয়ে হত্যা করা হয়৷ সালমান রুশদিও পাঁচ দশকের লেখালেখির জীবনে বহুবার মৃত্যুর হুমকি পেয়েছেন।