এক নজরে

ফুটবলপ্রেমী চে গুয়েভারা  

By admin

June 14, 2025

ফুটবল যদি কেবল খেলা হত তাহলে পেলে, মারাদোনা, মেসিরাই ফুটবল খেলতেন আর তা নিয়ে সাধারণ মানুষজন তত মাথা ঘামাতেন না। চে গুয়েভারাও ফুটবলকে ভালোবেসেছিলেন। নিজেও খেলেছেন। চে গুয়েভারার নাম শুনলেই আমাদের চোখে ভাসে একজন রোমান্টিক-বিপ্লবীর অবয়ব। এর্নেস্তো রাফায়েল গুয়েভারা দে লা সের্নাকে গোটা দুনিয়া ‘চে’ নামেই চেনে জানে। আর্জেন্টিনার মানুষ চে ছিলেন ডাক্তার। ভালোবাসতেন কবিতা শুনতে ও লিখতে। তিনি একই সঙ্গে ডাক্তার, লেখক, ভ্রমণপিপাসু, রাগবি, ফুটবল, দাবা খেলার ভক্ত, এবং বিপ্লবী। গোটা দুনিয়ার বিপ্লবপিপাসুদের মহানায়ক চে গুয়েভারা যৌবনে ফুটবল খেলতেন, ফুটবল ভালোবাসতেন মনেপ্রাণে।

হাভানায় খেলতে আসা ব্রাজিলের রিও ডি জেনেরিওর শহরতলির ছোট ক্লাব মাদুরিয়েরা স্পোর্তে’র শেষ ম্যাচ। খেলা দেখতে হাজির হয়েছিলেন চে। তিনি তখন কিউবার শিল্পমন্ত্রী। ১৯৬২’র চিলির বিশ্বকাপে পেলে, গারিঞ্চার ব্রাজিলকে নিয়ে তখন তুমুল উন্মাদনা। স্টেডিয়ামে না এসে পারেননি ‘কমানদান্তে’। স্টেডিয়ামে বসে দেখেন পুরো খেলা। মাদুরিয়েরা সেই ম্যাচ ৩-২ গোলে জেতে। খেলা শেষে চে গুয়েভারা খেলোয়াড়দের সঙ্গে আলাপ করে তাদের শুভেচ্ছা জানান। আসলে চে গুয়েভারা নিজেও ছিলেন ফুটবল-পাগল। কলেজ জীবনে রাগবি খেললেও ছেলেবেলায় ফুটবলই ছিল তাঁর ভালোবাসা।

গ্রামসির মতো ইনসাইড লেফট-ব্যাক নয়, চে গুয়েভারা চীন বিপ্লবের নায়ক মাও সেতুঙের বারপোস্টের নীচে দাঁড়িয়ে গোল রক্ষা করতেন। গোলকিপার পজিশনে খেলার কারণ ছিল, তাঁর হাঁপানি ছিল সে কারণে সবসময় তিনি পকেটে রাখতেন ইনহেলার। একথা জানা যায় চে গুয়েভারার অন্যতম জীবনীকার রিচার্ড হ্যারিসের লেখা ‘চে গুয়েভারা: এ বায়োগ্রাফি’ বই থেকে। মোটর সাইকেল ডায়ারিজে রয়েছে সেই বিবরণ। “বন্ধু আলবার্তো গ্রানাদোর সঙ্গে আন্দিজ পার হয়ে চিলি হয়ে উত্তরে পেরুর মাচু পিচ্চুতে পৌঁছে একটি দলের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল, ওরা তখন ফুটবল খেলছিল, আমরাও খেলার আমন্ত্রণ জোগাড় করে ফেললাম। বেশ কয়েকটা বিদ্যুৎগতিতে ট্যাকল করার পর আমি অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে ওদের কাছে স্বীকার করি আলবার্তোর সঙ্গে আমিও বুয়েনস আয়ার্সে প্রথম ডিভিশনে খেলেছি। আলবার্তো মাঝমাঠে তার কেরামতি দেখাল। মাঠটা এবড়ো খেবড়ো, যাকে স্থানীয় মানুষজন বলেন পামপা। অন্যদের তুলনায় আমাদের দু-জনের ভালো খেলা চোখে পড়ল বলের মালিকের। ঘটনাচক্রে তিনি আবার হোটেলের ম্যানেজারও বটে। অতএব তিনি আমাদের তাঁর ওখানে দিনকয়েক কাটানোর নেমন্তন্ন করে ফেললেন, যতদিন না বিশেষ রেলগাড়ি চড়ে আমেরিকানদের পরবর্তী দলটা এসে পড়ছে’’।

চের বন্ধু আলবার্তো গ্রানাদোর থেকেই জানা যায়, চে মাঠের মধ্যে বুলেটের বেগে ছুটতেন। আলবার্তো যে কারণে তাঁর নাম দিয়েছিলেন ‘গুলি’। এই আলবার্তোই লক্ষ্য করলেন মাঠে আসার সময়, কিংবা বিশ্রামের সময় চে বই পড়েন। একদিন আবিষ্কার করলেন চে ফ্রয়েড পড়ছেন। চেকে প্রশ্ন করে জানলেন, ফরাসিতেই তিনি ভল্টেয়ার পড়ে ফেলেছেন। ফ্রয়েড থেকে জ্যাক লন্ডন, নেরুদা থেকে হোরাসিও কিরোগা, আনাতোল ফ্রাঁস, এমনকি কার্ল মার্কসের দাস ক্যাপিটালও বুঝে কিংবা না-বুঝে পড়ে ফেলেছেন। মার্কসবাদী তাত্ত্বিক আন্তোনিও গ্রামসি বলেছিলেন, ‘‘ফুটবল হল ব্যক্তিকেন্দ্রিক সমাজের মডেল। ফুটবল চায় সৃজনশীলতা। ফুটবল মানে প্রতিযোগিতা, সংঘাত। কিন্তু এটি নিয়ন্ত্রিত হয় একটি সংগঠিত খেলার অলিখিত নিয়মের মধ্যে’’। আর চে গুয়েভারা বলেছিলেন, “ফুটবল নিছক একটি সাধারণ খেলা নয়, এটি বিপ্লবের একটি হাতিয়ার’’।

প্রসঙ্গত, শুধু গ্রামসি কিংবা চে গুয়েভারা নয়, আলবেয়ার কামুও ফুটবলের ভক্ত ছিলেন। ফরাসি বংশোদ্ভূত এই আলজেরীয় সাহিত্যিকও গোলকিপার পজিশনে খেলতেন, কারণ ওই পজিশনে খেললে জুতোর ওপর কম চাপ পড়বে, ছেড়া-ফাটা কম হবে। গরিব বাড়ির ছেলে কামুর পক্ষে ফুটবল মাঠে দৌড়ানোর মতো বিলাসিতা দেখানোর সুযোগ ছিল না। প্রতিদিন তার দাদি জুতোর শুকতলা পরীক্ষা করে দেখতেন, ছেড়া-ফাটা দেখলেই মারধর করতেন। এক-নম্বর জার্সি পরে গোলপোস্টের নিচে দাঁড়িয়ে কামু শিখেছিলেন তার জীবনদর্শন, তিনি বলেছিলেন, ‘‘আমি শিখেছিলাম, যখন তুমি আশা করছ এবারে বল আসছে, সেই সময় বল কখনোই আসে না, যে উপলব্ধি আমাকে জীবনের জন্য ভীষণভাবে সাহায্য করেছিল, বিশেষত বড় শহরগুলিতে থাকার সময়, যেখানে মানুষ সাধারণত যা দাবি করেন, সেদিকে আদৌ কখনো ঝোঁকেন না।’’ নোবেলজয়ী লেখকের কাছে ফুটবল ছিল প্রথম প্রেম। কামু প্রথমে স্কুল টিমের গোলকিপার। পরে যক্ষ্মায় আক্রান্ত না হওয়া পর্যন্ত রেসিং উনিভার্সিতেয়ার আলজেরোয়া (আরইউএ) জুনিয়র টিমের নিয়মিত কিপার। খেলেছিলেন উত্তর আফ্রিকান চাম্পিয়ন কাপ। রোগশয্যা থেকে ফিরে আট বছর বাদে আবার নামেন খেলার মাঠে। কিন্তু ফুসফুস তখন এতটাই ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছে, যে শরীর আর খেলার সুযোগ দেয়নি।