অদ্ভুতুড়ে

চারশো বছর ধরে সমুদ্রে ভেসে চলেছে

By admin

March 06, 2024

সমুদ্রে হঠাৎ কুয়াশা নামলো। জাহাজের সামনে ভেসে উঠল অন্ধকার। যেন জাহাজটাকে গিলে ফেলবে। ভয়ে সিঁটিয়ে গিয়েছে সাধারণ নাবিকেরা। এক হাত দূরের কোনও মানুষকেও দেখা যাচ্ছে না। কম্পাসের কাঁটা কোন দিকে নির্দেশ করছে, বুঝতে পারছেন না অভিজ্ঞ ক্যাপ্টেন। অতল জলরাশির মধ্যে অন্ধের মতো এগিয়ে চলেছে জাহাজ। অন্যদিকে সেই অন্ধকার দ্রুত গতিতে এগিয়ে আসছে যেন এই জাহাজ লক্ষ্য করেই। সমুদ্র যতটা মোহময়ী, ততটাই ভয়ংকরী। তার রাজ্যে মানুষের অনুপ্রবেশ সে মেনে নিয়েছে বটে, তবে ইচ্ছে হলেই যে কোনও দিন তাদের উপর বিরূপ হয়। পথ ভুল করে জাহাজ, ধাক্কা খায় হিমশৈলে, কিংবা নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। সমুদ্রের বুকে পাড়ি দেওয়া জাহাজের বন্দরে ফেরা ঘটে না। এমন অনেক জাহাজের কথা শোনা যায়, যারা স্রেফ উধাও হয়ে গিয়েছে সমুদ্রের বুকে। জাহাজের সঙ্গে সঙ্গেই হারিয়ে গিয়েছে তার ভিতরে থাকা মানুষও।

সেই কুয়াশাই যেন ঘিরে ধরেছে এই জাহাজটিকে। আর সেই কুয়াশার মধ্যে দিয়ে জাহাজের দিকে এগিয়ে আসছে ওই অন্ধকার। এবার যেন আবছা দেখা যাচ্ছে, তার মাথায় তোলা পাল। মাস্তুল। সামনের ছুঁচলো অংশ। কিন্তু আরেকটা জাহাজ। সেও নিশ্চয় পথ হারিয়েছে। প্রাণপণে চিৎকার করতে থাকে নাবিকেরা। দুটি জাহাজ এত কাছাকাছি, ধাক্কা লাগলে সলিল সমাধি নিশ্চিত। কিন্তু, হঠাৎ যেন আবছা হয়ে এল রহস্যময় কুয়াশা। স্পষ্ট হয়ে উঠল আগন্তুক জাহাজের অবয়ব। পড়া গেল তার গায়ে লেখা নাম- ‘ফ্লায়িং ডাচম্যান’! কিন্তু হঠাৎ করেই মিলিয়ে গেল সেই জাহাজ আর সঙ্গে সঙ্গে মিলিয়ে গেল কুয়াশা।

১৮৩৫ সালে একটি ব্রিটিশ জাহাজের রিপোর্টে লেখা হয়েছিল, আচমকাই তাদের জাহাজের খুব কাছে ভেসে উঠেছিল সেই ভৌতিক জাহাজ। পাল তুলে জোর গতিতে সেই জাহাজ সরাসরি ছুটে আসছিল ব্রিটিশ জাহাজটির দিকে। দুই জাহাজের মধ্যে সংঘর্ষ যখন নিশ্চিত, তখন হঠাৎ করেই আবার অদৃশ্য হয়ে যায় সেই জাহাজ। সেই প্রথম নয়, এর আগেও একাধিক জাহাজ জানিয়েছে একই ঘটনার কথা। যে জাহাজটি একদিন আচমকা হারিয়ে গিয়েছিল সমুদ্রের বুক থেকে, সেই সমুদ্রেই নাকি বারবার দেখা দিয়েছে সে। ‘কেপ অফ গুড হোপ’-কে জাহাজের গোরস্থান বলা যেতে পারে। এই উপকূলের আশেপাশে ছড়িয়ে রয়েছে অজস্র ডুবোপাথর। যে কোনও সময় তাতে ধাক্কা লেগে সলিলসমাধি ঘটতে পারে জাহাজের। আর এই অঞ্চল ঘিরেই শোনা যায় গুজব। মাঝে মাঝেই নাবিকরা নাকি এখানে দেখতে পায় কয়েক শতাব্দী আগের একটি জাহাজকে, যার পরিণতি কী হয়েছিল কেউই জানে না। সেই জাহাজ নাকি এখনও অভিশপ্ত আত্মার মতো ঘুরে বেড়ায় সাগরের বুকে।

সতেরো শতকের কোনো এক সময় ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হয়ে অভিযানে বেরিয়েছিল ফ্লাইং ডাচম্যান। সিল্ক, রঞ্জক আর মশলা নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার আটলান্টিক উপকূল ঘেঁষে নিজের দেশ নেদারল্যান্ডের দিকে ফিরছিল সেই বাণিজ্যতরী। শোনা যায়, ফেরার পথে প্রচণ্ড ঝড়ের কবলে পড়ে। জাহাজ তখন কেপ অব গুড হোপ-এর কাছাকাছি। একে প্রতিকূল আবহাওয়া, তার ওপর উপকূলবর্তী ডুবোপাথরের ভিড়, সব মিলিয়ে দুর্ঘটনার আশঙ্কায় ত্রস্ত হয়ে উঠেছিল জাহাজের নাবিকেরা। কিন্তু কিছুতেই জাহাজ থামাতে রাজি হননি ক্যাপ্টেন হেড্রিক ভ্যান ডের ডেকেন। এমনকি, নাবিকেরা তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করলে বিদ্রোহী নেতাকে হত্যা করে সমুদ্রে ছুড়ে ফেলেন ক্যাপ্টেন, এমনটাও শোনা যায়।এরপর ফ্লাইং ডাচম্যানের ভাগ্যে ঠিক কী ঘটেছিল, সে কথা কেউ বলতে পারে না। জাহাজের কোনও ধ্বংসাবশেষও মেলেনি।

অনেকেই জাহাজ বা উপকূল থেকে ফ্লাইং ডাচম্যান-কে দেখা গিয়েছে বলে দাবি করে। ১৭৯০ সালে নিজের বইয়ে এই জাহাজের উল্লেখ করেন জন ম্যাকডোনাল্ড নামে এক সমুদ্র-পর্যটক। রয়্যাল শিপ এইচ. এম. এস ব্যাশান্ট-এর ১৮৮১ সালের ১১ জুলাইয়ের লগবুকেও উল্লেখ রয়েছে এই ভূতুড়ে জাহাজের। অথচ সেদিন প্রতিকূল আবহাওয়া তো দূর, আকাশে নাকি মেঘের লেশ মাত্র ছিল না। কিন্তু আশেপাশের অঞ্চলে তন্নতন্ন করে খুঁজেও সমুদ্রের বুকে হঠাৎ দেখা দিয়ে মিলিয়ে যাওয়া জাহাজটির হদিশ পায়নি রয়্যাল শিপের নাবিকেরা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এক জার্মান সাবমেরিনও এই ভূতুড়ে জাহাজ দেখতে পেয়েছে বলে দাবি করেছিল। এইসব কাহিনি কতটা ঘটনা আর কতটা রটনা, সে নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। তবে ফ্লাইং ডাচম্যানের পরিণতি কি হয়েছিল তা অজানাই রয়ে গেছে।