এক নজরে

ট্রেকারের পাদানি থেকে মেছোঘেরি

By admin

February 26, 2024

ইডি-সিবিআইয়ের তল্লাশি অভিযানে নেতা মন্ত্রীর বাড়ি থেকে কোটি কোটি টাকা উদ্ধারের ছবি গত ২ বছর ধরে আমরা অনেকবার দেখেছি। নতুন বছরের শুরুতেই (৫ জানুয়ারি) দেখলাম কেন্দ্রীয় সংস্থার অফিসারের মাথা ফেটে গলগল করে রক্ত বেরচ্ছে। না হিন্দি ছবির দৃশ্য নয়, উত্তর ২৪ পরগনার সন্দেশখালি অঞ্চলে এক নেতাকে গ্রেফতার করা নিয়ে এমন তাণ্ডবকাণ্ড। তিনি মন্ত্রী বা বিধায়ক নন, জেলা পরিষদের কর্মাধ্যক্ষ। সন্দেশখালির বাইরে হাতেগোনা কয়েকজন মানুষ যে নামটি জানতেন, সেই নামটি জানে এখন সারা বাংলার মানুষ। তবে নেহাতই একটা পদের অধিকারী হলেও সন্দেশখালিতে এই নেতার ইশারা ছাড়া নাকি গাছের একটি পাতাও নড়ত না। এই নেতার নাম শেখ শাজাহান, তিনি সন্দেশকালির ‘বেতাজ বাদশা’। আর তারপর থেকেই সন্দেশখালি কেবলমাত্র সংবাদের শিরোনাম নয়, চর্চার অন্যতম বিষয়। প্রতিদিন কাহিনিচিত্রের মতো সন্দেশখালি ও শেখ শাজাহানকাণ্ডের ঘটনাক্রম নানা বাঁকে মোর ঘুরছে, বদলাচ্ছে প্লট। পটভূমিতে অ্যাকশন থেকে ড্রামা, সাসপেন্স থেকে থ্রিল, সব আছে। এমনকি ক্লাইম্যাক্সও, তবে সেটা এখনই নয়, তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে আরও কয়েকটি দিন।

ইডি-র ওপর হামলার পর থেকে বেপাত্তা সন্দেশখালির ‘বেতাজ বাদশা’ শেখ শাহজাহান। যদিও প্রভাবশালী তৃণমূল নেতা শিবপ্রসাদ ইতিমধ্যে গ্রেফতার হয়েছেন। শেখ শাহজাহান-ঘনিষ্ঠ ওই নেতা ‘পলাতক’ ছিলেন। ন্যাজাট থানা এলাকা থেকে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে পুলিশের একটি সূত্রে খবর। বস্তুত, সন্দেশখালিকাণ্ডে সদ্য গণধর্ষণ ও খুনের চেষ্টার ধারা যোগ করেছে পুলিশ। তাতে অভিযুক্ত হিসাবে নাম রয়েছে বহিষ্কৃত তৃণমূল নেতা উত্তম সর্দার এবং তৃণমূল নেতা শিবপ্রসাদের। পাশাপাশি, খুনের চেষ্টার ধারাতেও মামলা রুজু হয়েছে। তবে এখনও অধরা শেখ শাহজাহান, তিনি এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাই সন্দেশখালিতে বিক্ষোভের আগুন জ্বলছে যা খুব তাড়াতাড়ি নিভবে না। শাহজাহানকে গ্রেফতারির দাবিতে ক্ষোভে ফুঁসছেন সন্দেশখালিবাসী। এই আবহের মধ্যে এবার শাহজাহানের বিরুদ্ধে সন্দেশখালি থানায় নতুন করে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। গৌর দাস নামে এক ব্যক্তি দাপুটে ওই তৃণমূল নেতার বিরুদ্ধেও অভিযোগ দায়ের করেছেন বলে পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে।

আজকের জনরোষের আগে সন্দেশখালির ‘বেতাজ বাদশা’ শেখ শাহজাহানের বিরুদ্ধে অভিযোগ করার সাহস ছিল না কারও। কেউ বুকে সাহস নিয়ে থানায় গেলেও পুলিশ অভিযোগ জমা না নিয়ে ফিরিয়ে দিত। আজ কিন্তু ছবিটা কিছুটা হলেও বদলেছে। সন্দেশখালিতে ক্ষোভের আগুন জবলে উঠতেই দুয়ারে পুলিশ ক্যাম্প শুরু হয়েছে। সেখানে অভিযোগ জমা নেওয়া শুরু হয়েছে। পাশাপাশি থানাতেও অভিযোগ জমা নেওয়া হচ্ছে। জানা গিয়েছে, নতুন এফআইআরে শাহজাহানের বিরুদ্ধে বেশ কিছু অভিযোগ রয়েছে। পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, অভিযোগকারী গৌরবাবুর ৮০ হাজার টাকা লুট করা হয়েছে। এছাড়া, তাঁর ঘরবাড়ি ভাঙচুরের অভিযোগও রয়েছে শাহজাহানের বিরুদ্ধে। তবে, শুধু শাহজাহান একা নন, শিবু হাজরা, উত্তম সর্দার-সহ মোট আট জনের বিরুদ্ধে ওই এফআইআর হয়েছে। এতদিন যে পুলিশ অভিযোগ নিত না। সেই অভিযোগের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে বসিরহাট জেলা পুলিশ। এমনটাই জানাচ্ছেন এলাকাবাসীরা।

সুন্দরবন লাগোয়া সন্দেশখালির মতো প্রত্যন্ত গ্রামের বাসিন্দা, বছর পঞ্চাশের শেখ শাহজাহানের ২০২৩-এর পঞ্চায়েত ভোটে নির্বাচন কমিশনে দেওয়া হলফনামা অনুযায়ী- সরবেড়িয়ায় দেড় কোটি টাকার বাড়ি, ব্যাঙ্কে ১ কোটি ৯২ লক্ষ ১২ হাজার টাকা, ১৭টি গাড়ি, আড়াই কোটি টাকার গয়না, ৪৩ বিঘা জমি ইত্যাদি। যিনি সন্দেশখালি-সরবেড়িয়া রুটে ট্রেকারের পাদানিতে দাঁড়িয়ে যাত্রীদের থেকে ভাড়া আদায় করতেন তিনি কীভাবে এই সম্পত্তির মালিক হলেন? স্থানীয় মানুষের বক্তব্য, বাম জমানার শেষ যুগেই শাজাহান বিরাট সম্পত্তির মালিক হতে শুরু করেছিলেন সরবেড়িয়া এলাকার দাপুটে সিপিএম নেতা তথা পঞ্চায়েত প্রধান মোসলেম শেখের সৌজন্যে। কেবল তাই নয় তিনি সন্দেশখালির প্রাক্তন সিপিএম বিধায়ক প্রয়াত অবনী রায়েরও পছন্দের মানুষ ছিলেন। বাম জমানায় সিপিএমের নেতা না হলেও শাজাহান ওই এলাকার বেশ কয়েকটি বুথে ভোট করাতেন। ইতিমধ্যে শাজাহান ট্রেকারের পাদানি ছেড়ে হয়ে যান মেছোঘেরির নিয়ন্ত্রক। উত্তর ২৪ পরগনার বারাসত ব্লকের শাসনে যেমন ভেড়ি নিয়ন্ত্রণ করতেন সিপিএম নেতা মজিদ মাস্টার, তেমনই সন্দেশখালির ভেড়ি নিয়ন্ত্রণের ভার ছিল তাঁর উপর। বাম জমানা থেকেই শাহজাহানের সম্পত্তি বৃদ্ধিতে অনেকেরই নজর লাগে। কিন্তু  শাজাহান সেই নজর এড়াতেন কার মেয়ের বিয়ে হচ্ছে না, কার ছেলের অসুখ, কার সন্তানের বইখাতা কিনতে হবে— তার মুশকিল আসান করে।  

ক্রমশ…