এক নজরে

কলকাতার প্রথম চিন সাম্রাজ্য

By admin

March 12, 2022

টং অছিও সবার মন জিতে নিলেন। সে দিন কেবল জমিদারই নন, তৎকালীন গভর্ণর লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংসের মুখেও চা নামক বস্তুটির স্বাদ পৌঁছে গেল। টং অছির সঙ্গে সাক্ষাৎ হল হেস্টিংস সাহেবের।

চিনের রাজতন্ত্রে সেই সময় ইউরোপিয়ানদের প্রবেশাধিকার ছিল না। কিন্তু ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির পক্ষে চিনের বিশাল ভূখন্ডের বিরাট বাজারকে উপেক্ষা করা সম্ভব ছিল না। ইতিমধ্যে গভঃ জেনারেল হেস্টিংস কূটনৈতিক স্তরে তীব্বত ও চিনের সঙ্গে ব্যবসায়ীক সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা চালাচ্ছিলেন। ঠিক সেই সময় চিনা ব্যবসায়ী ইয়াং তা চাও –এর ভারতে পদার্পণ নিঃসন্দেহে হেস্টিংসের সামনে ব্যবসায়িক ও রাজনৈতিক মুনাফার এক নতুন রাস্তা খুলে দেয়।ওয়ারেন হেস্টিংস সেই সময় কলকাতাকে কল্লোলিনী বানানোর তাগিদে নানান পরিকল্পনা গ্রহণ করছিলেন। এরপরই টং অছির সঙ্গে হেস্টিংসের কথা হয়। তাদের কথা মতো অছি বজবজের ৬ কিলোমিটার দক্ষিণে একটি জমি নেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে বছরে ৪৫ টাকা ভাড়া দেবেন অছি। তার বিনিময়ে তিনি পেয়ে যান ওই অঞ্চলের  প্রায় সাড়ে ছ’শো বিঘা জমি।  

গঙ্গার ধারের সেই ঊর্বর জমিতে অছি আখ চাষ শুরু করেন। পাশাপাশি গড়ে তোলেন চিনির কারখানা। এরপর একে  একে সেখানে ১১০ জন চিনা শ্রমিকও এসে জড়ো হলেন। আখ চাষ আর চিনির কল ঘিরে সেখানে গড়ে উঠল চিনা কলোনি। অছির নামে বজবজের উপকণ্ঠে গড়ে ওঠা সেই চিনা কলোনি আজকের অছিপুর।যতদূর জানা যায়, টং অছি প্রথম চিনা নাগরিক যিনি বাংলায় বসতি স্থাপন করেছিলেন। আজও অছিপুরে রয়েছে তাঁর সমাধিস্থল। একেবারে নদীর পাড়ে টং অছির সেই সমাধি লাল রঙের অশ্বক্ষুরাকৃতির মতো। সেই সমাধির রক্ষণাবেক্ষণ করেন এলাকার মানুষরাই, যাঁদের বেশিরভাগই মুসলিম ধর্মাবলম্বী। কিন্তু, আশ্চর্যভাবে ধর্ম এখানে বাধা সৃষ্টি করতে পারেনি।

অছিপুরে টং অছির আমল থেকেই রয়েছে চিনা সম্প্রদায়ের একটি ছোট্ট মন্দির। অছিপুর ফেরিঘাটের আগে একটা বাঁদিকের রাস্তা সোজা চলে গেছে বটতলা থেকে চিনেম্যানতলা। এখানেই আছে ইস্টবেঙ্গলের পতাকার রঙে সজ্জিত একটি চিনা-উপাসনাগৃহ। মন্দিরটি পরিচালিত হয় ব্ল্যাকবার্ণ লেন বৌবাজার থেকে। কোনোদিন বেখেয়ালে হাঁটতে হাঁটতে সেখানে গেলে লালের সমাহারে থমকে দাঁড়াতে হয়। আছিপুরে কোনও চৈনিক পরিবার বর্তমানে না থাকলেও, বছরের একটি দিন সেখানকার ওই মন্দির চত্বর উৎসবের রূপ নেয়। মন্দিরের আরাধ্য দেব-দেবীর নাম ‘খুদা’ ও ‘খুদি’। তাঁদের ‘উর্বরতা’র দেব-দেবী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। চিনা ভাষায় তাঁরা হলেন ইন ও ইয়াং।

প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি মাস এলেই কলকাতার চিনেপাড়ার সঙ্গে সেজে ওঠে অছিপুরের চিনা মন্দির। মন্দিরের লালের পোচ আরেকটু গাঢ় হয়। চিনা নববর্ষে আয়োজিত হয় নানান উদ্‌যাপন-অনুষ্ঠান। পুজিত হন টম অছির আনা দুই দেবমূর্তি– ‘খোদা-খুদি’। তবে চিনা মন্দিরে যে শুধু চিন-দেবতাই পূজিত হন তাই নয় , একাসনে সেখানে পুজো পায় বাংলার ‘দক্ষিণরায়’ ও ‘বনবিবিও’। সেই মন্দিরের অদূরেই অছিপুর ইঁটভাটার মাঝে এক খাঁড়ির ধারে অবস্থিত লাল অর্ধবৃত্তাকার সমাধিক্ষেত্র টং অছির দেহাবশেষ। সেই সমাধিস্থল থেকে বেরিয়ে উত্তরদিকে একদা ছিল উপমহাদেশের প্রথম চিনি কল।