এক নজরে

নোবেল পেলেও রোনাল্ড রস চাকরিতে বারবার বদলি হয়েছেন  

By admin

May 13, 2023

ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত প্রচুর মানুষকে চোখের সামনে মরতে দেখেছিলেন তিনি। কীভাবে সেই ম্যালেরিয়াকে প্রতিরোধ করা যায়, তা নিয়েও ভাবতেন নিয়মিত। উপরে উল্লেখিত পংতিগুলি তাঁরই লেখা;ম্যালেরিয়া নিয়ে একটি কবিতাও তিনি রচনা করেছিলেন।

রোনাল্ড রস ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন দেখতেন তিনি একজন লেখক হবেন। তাঁর লেখা নিয়ে চর্চা হবে, তিনি পাঠকদের সমাদর পাবেন এবং তিনি ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবেন। তিনি চিকিৎসাশাস্ত্রের প্রতি তাঁর কোনও দিনই তেমন অনুরাগ ছিল না। রোনাল্ড চিকিৎসাশাস্ত্র নিয়ে কোনওদিন পড়াশোনাই করতে চাননি। যদিও লেখালেখি করে যে তিনি বিশেষ সম্মান আদায় করতে পেরেছিলেন এমনও নয়।তবু আপনমনে সারাজীবনই তিনি লিখেছেন। অবসর সময়ে কবিতা, উপন্যাস, এমনকি মঞ্চনাটকও লিখেছেন। এছাড়া রোনাল্ড নিয়মিত ছবি আঁকতেন। সঙ্গীতের প্রতিও তাঁর আগ্রহ ছিল। বাদ্যযন্ত্র বাজাতে তিনি পছন্দ করতেন।

রোনাল্ড রস জন্মেছিলেন হিমাচলপ্রদেশের আলমোরায়। কিন্তু তাঁর বাবা আট বছর বয়সেই তাঁকে পাঠিয়ে দেন ইংল্যান্ডে। সেখানেই বোর্ডিং স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা।তারপর বাবার ইচ্ছায় লন্ডনের সেইন্ট বার্থোলোমিউ হাসপাতালে ডাক্তারি পড়া। যদিও ডাক্তারি পড়াশোনায় কখনোই মন বসত না তাঁর।অধিকাংশ সময়েই তিনি কবিতা লেখা কিংবা বাদ্যযন্ত্র বাজাতে ব্যস্ত থাকতেন।আবার ছোটবেলা থেকেই গণিতে ছিলেন তুখোড়।

ডাক্তার হিসেবে চাকরির শুরুতে রোনাল্ড ছিলেন মাদ্রাজে। সেখানেই তিনি ম্যালেরিয়া আক্রান্ত বহু সৈনিকের চিকিৎসা করেন। তখন ম্যালেরিয়ার চিকিৎসায় কুইনাইনই সফলভাবে ব্যবহৃত হত।এখনো ম্যালেরিয়ার ওষুধ কুইনাইন থেকেই তৈরিহয়। রোনাল্ড লক্ষ্য করেন করেন বহু ম্যালেরিয়া আক্রান্ত সৈনিক মারা যাচ্ছে সময় মতো চিকিৎসার অভাবে। তিনি ম্যালেরিয়ার চিকিৎসার থেকে প্রতিরোধের কথা বেশি ভাবতে শুরু করেন।

ইতিমধ্যে তিনি বদলি হয়ে যান ব্যাঙ্গালুরুতে। সেখানে সন্ধ্যা হলেই মশার উপদ্রবে আর বসা যেত না। একদিন রোনাল্ড খেয়াল করেন, জানালার বাইরে একটি ড্রামের ওপরে প্রচুর মশার আনাগোনা। বাইরে গিয়ে দেখেন ড্রামের মধ্যে জমা জলে প্রচুর মশার লার্ভা ভাসছে। তিনি ড্রামের জল ফেলে দেন। কিছুদিন পর খেয়াল করেন মশার উপদ্রব আগের থেকে কম।

বিষয়টি কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিতে আনা হলেও রোনাল্ডের পরামর্শ গুরুত্ব পায় না। তার গবেষণা কাজেও কর্তৃপক্ষ বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে বহুবার।রোনাল্ডকে সারাজীবন চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে নিজের উদ্যোগে ও খরচে গবেষণা চালাতে হয়েছে। এত কিছু ঝামেলার মধ্যেও রোনাল্ড গণিতচর্চা করতেন, গণিতে নতুন কিছু করতে চাইতেন।এছাড়াও গান, কবিতা, নাটক, উপন্যাস লিখে লিখে নিজের খরচেই বই প্রকাশ করতেন।

এক দিকে কতৃপক্ষের সঙ্গে নানা ঝামেলা, বার বার বদলি, অন্য দিকে উপযুক্ত পরিকাঠামোর অভাব। শেষ পর্যন্ত কলকাতায় এসে তিনি ব্যক্তিগত খরচায় সহকারী নিয়োগ করলেন। কিন্তু পরীক্ষা করার মতো রোগী কই? তখন কলকাতায় ম্যালেরিয়া ও প্লেগ মহামারীর আকার ধারণ করেছে, ভয়ে মানুষ সহযোগিতা করতে চাইছে না। সহকারী টাকার লোভ দেখিয়ে রাস্তা থেকে লোক ধরে আনলেন। রক্ত-পরীক্ষার নাম শুনে তারাও পালাল।

Credit: Wellcome Library, London. Wellcome Images

এরপর পাখিদের ওপর পরীক্ষা শুরু হল।সেই সময় কন্ট্রোল্ড ট্রায়ালের রেওয়াজ চালু হয়নি। মশারির মধ্যে পাখিদের সঙ্গে তিনি ম্যালেরিয়ার জীবাণুবাহী মশাদের রেখে দিলেন। আর অন্য একটা মশারিতে পাখিদের সঙ্গে কিছু সাধারণ মশা। এ ভাবেই তিনি অ্যানোফিলিস মশার কামড়ে ম্যালেরিয়া রোগ ছড়ানোর গোপন তত্ত্ব আবিষ্কার করেন।কিন্তু আশ্চর্য, এই আবিষ্কারের কিছু দিনের মধ্যেই ফের তাঁকে বদলি করা হয়েছিল। শেষপর্যন্ত হতাশ হয়ে তিনি ইন্ডিয়ান মেডিকাল সার্ভিস-এর চাকরি থেকে ইস্তফা দেন। কিন্তু তারপরেও তিনি কাজ করেছেন, ম্যালেরিয়া কন্ট্রোল প্রোগ্রাম-এর তিনি পুরোধা হয়ে ওঠেন। বিভিন্ন স্যানিটেশন প্রোগ্রামের মাধ্যমে মশার প্রজনন বৃদ্ধি বন্ধের চেষ্টা করে গিয়েছেন।

দুর্ভাগ্য মানুষটি তাঁর ব্যবহারিক জীবনে তেমন সফল ছিলেন না। জীবনের শেষ ভাগে নাকি গবেষণার স্বত্বও বিক্রি করতে চেয়েছিলেন। লিভারপুলে কাজ করার সময়ও তিনি দু’বার পদত্যাগ করেন এবং পেনশন থেকে বঞ্চিত হন। তবু একথা আজ বলাই যায় যে করোনার বিষাক্ত ফণা যেভাবে আমাদের অসহায় করে ফেলেছে তাতে আবার একজন স্যর রোনাল্ড রস বা তাঁর যথার্থ উত্তরসূরির খুবই  প্রয়োজন।