না-বলা কথা

ওদের পূজা

By admin

October 15, 2020

অতিরিক্ত জেলাশাসক, ঝাড়গ্রাম

বিগত কয়েক বছরের মত ২০১৬ সালের পুজোয় আমি কলকাতার বাইরে ছিলাম। তফাৎ শুধু অন্যান্য বছরে বঙ্গের বাইরে থাকি, কিন্তু সেবারে ছিলাম পশ্চিমবঙ্গেরই একদম পশ্চিম প্রান্তে বাঁকুড়া জেলার খাতড়া মহকুমায়। প্রতি বারই সারা বছর জুড়ে ইন্টারনেট সার্ফিং করে স্পট খুঁজতে খুঁজতে সেই পাহাড় আর জঙ্গল, সেই হিমালয়ই অগ্রগণ্যতা পেয়ে যায়। প্রতিবারই প্রমিস করি পরের বার অন্য কোথাও, কিন্তু বাই ডিফল্ট সেই পাহাড় আর জঙ্গল পছন্দের তালিকায় শীর্ষের দশটা স্থানের দশটাই দখল করে নেয়।

এক বছর আগে যখন ট্রান্সফার অর্ডার হাতে পাই তখন এক হাহাকার অবস্থা, বেশ ছিলাম কলকাতায়। স্ত্রী, পুত্র নিয়ে অল্পস্বল্প কাজের চাপ সামলে পাঁচটা বছর ভালোই কাটছিল। তার আগে উত্তর দিনাজপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর, বর্ধমান ও মালদা হয়ে এসে ঠেকেছিলাম কলকাতায়। হঠাৎ এক ট্রান্সফার অর্ডারে গতানুগতিক জীবনে যেন ছেদ পড়ল। স্ত্রী, পুত্রকে কলকাতায় রেখে এসে বাঁকুড়ার খাতড়া মহকুমায় প্রশাসনের ভীষণ দায়িত্ব নিতে হল।

এই এক বছরে বেশ খানিকটা সামলে নেওয়া গেছে। পরিবারও আমাকে ছাড়া কলকাতার ভিড় ঠেলা জীবনে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। এই পাহাড় আর জঙ্গলে ঘেরা জঙ্গলমহলে আমার একাকীত্বের সঙ্গী করে নিয়েছি গান আর বইকে। সব রকম গানই শুনি। এ ব্যাপারে আমার কোনও ছুৎমার্গ নেই। হানি সিং থেকে ওস্তাদ রশিদ খাঁ বা হ্যান্স জিমার থেকে আমজাদ আলি খান কাউকে বাদ দিই না। ইউটিউবে যখন যেমন মনে হয় তেমন চালিয়ে নিই। তবে বুদ্ধদেব গুহ ও বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বই পড়তে পড়তে তাদের চোখে দেখা ও লেখনীর বর্ণনায় ফুটে ওঠা পালামৌ আর সিংভূমের জঙ্গল আর পাহাড়ের সঙ্গে নিজের পারিপার্শ্বিককে মিলিয়ে নিয়েছি। তাদের বইয়ের পাতায় বর্ণিত নদী, পাহাড়, জঙ্গল আর মানুষজনের মাঝখানে আমিও যেন একটি চরিত্র হয়ে উঠেছি।

সেবারের পুজোতে কলকাতা থেকে স্ত্রী, পুত্র, বাবা ও মাকে আমার এখানে নিয়ে এসেছি এবং প্রতিশ্রুতি দিয়েছি রোজ ঠাকুর দেখা, খাওয়াদাওয়া ও পাহাড় জঙ্গল ঘোরার প্যাকেজের গাইড ও আয়োজক দুটোই আমি। ভ্রমণ তালিকায় সপ্তমীর দিন ছিল পাশের সিংভূম জেলা ও টাটানগরী দর্শন। সকাল সকাল সবাইকে নিয়ে খাবারদাবার গুছিয়ে এবং পেনড্রাইভে পছন্দের গান সাজিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। খাতড়া মহকুমার পশ্চিম প্রান্তে বাঁকুড়া জেলার শেষ সীমানায় রানীবাঁধ ব্লক। তারপরই বান্দোয়ান ব্লক ও পুরুলিয়া জেলার শুরু। রওনা হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রাথমিক জড়তা কাটতে না কাটতেই বাঁকুড়া জেলার সীমানা ছাড়িয়ে আমরা পৌঁছে গেলাম পুরুলিয়া জেলায়।

পুরুলিয়া জেলা মানে আপামর বাঙালীর মনে যে চিত্রটা ভেসে ওঠে তা হল পাহাড়, জঙ্গল, ছৌ নাচ আর আদিবাসী। আদিবাসী শব্দে আমার আপত্তি আছে। আদিবাসী আর উপজাতি – দুটি শব্দের অর্থ ভিন্ন, কিন্তু আমরা মিলিয়ে মিশিয়ে উভয়কেই আদিবাসী করে নিয়েছি অর্থাৎ এরা কোনও একটি এলাকার প্রাচীন জনগোষ্ঠী যারা আলাদা রাষ্ট্র গঠন করতে পারেনি কিন্তু নিজস্ব একটি আলাদা সংস্কৃতি গড়ে তুলতে সমর্থ হয়েছে। তাও কেন যে ওরা এখনও ভারতীয় মানে ইন্ডিয়ান হয়ে উঠতে পারল না তা কে জানে। আমরাও কেন যে ওদের ভারতীয় ভাবতে পারি না। ওরা ট্রাইবাল। ওরা মানে শুধু ধামসা, মাদল আর বাঁশির সুরে পা নাচানো। মাদল আর বাঁশির সুরে পথ চলতে চলতে ওদের সঙ্গে দেখা হল। কি সুন্দর রঙিন পোষাকে সেজেছে ওরা। ছেলেদের মাথায় রঙিন কাপড় বাঁধা, কোমরে ধুতির মত করে কাপড় জড়ানো, মাথায় ময়ূরের পালক গোঁজা, মেয়েরা সবুজ – সাদা বা লাল – সাদা কাপড়ে দারুন সেজেছে। বান্দোয়ানের শেষপ্রান্তে এসে দেখি ধামসা মাদল আর বাঁশির সুরে সুরে পা মিলিয়ে ওরা রাস্তা জুড়ে এগিয়ে চলেছে। চলতি পথে ছোট ছোট এরকম অনেক দলকে দেখলাম, ছোট ছোট ছেলেমেয়ে থেকে যুবক যুবতী এমনকি বয়স্করাও রয়েছে সেই দলে।

দীর্ঘ যাত্রাপথে চা – এর তেষ্টা মেটাতে আমরা যখন থমকে দাঁড়িয়ে তখন ঐ রকম একটি দল আমাদের পেরিয়ে এগিয়ে চলেছে। আমার বারো বছরের ছেলে ঋষি খুব ঔৎসুক্য নিয়ে দেখছিল। সে জিজ্ঞাসা করল – বাবা, আক কি ওদেরও দুর্গাপূজার সপ্তমী? আমি কিছু ভেবে উত্তর দেবার আগেই চায়ের দোকানের ছেলেটা জানালো যে পূজার কটাদিন রোজই ওরা এভাবে শোভাযাত্রা বের করে। পথচলতি মানুষ খুশি হয়ে যেটুকু অর্থ দান করে তাই দিয়েই ওরা সন্ধ্যায় পূজার আয়োজন করে। কত ক্ষুদ্র আয়োজন অথচ কি আন্তরিক প্রচেষ্টা। ঋষি বলল – বাবা, ওদের কোনও বিলবই নেই? ওদের কোন থিম আছে? ওদের কোনও বিজ্ঞাপনের দরকার হয় না? এতও সিম্পল ভাবেও দুর্গাপূজা হয়? আমি কোনও সদুত্তর দিতে পারিনি। সত্যিই তো কলকাতায় যেখানে কোটি কোটি টাকা বাজেট, কত আলোর রোশনাই, শত শত কারিগর কয়েক মাসের শ্রমে আশ্চর্য সব ভাস্কর্যের কোলাজ তৈরি করছে, সেখানে একদিনের এই শোভাযাত্রায় কতই বা আর সংগৃহীত হবে? তবে কি এদের দুর্গা আর কলকাতার দুর্গা আলাদা? চারপাশের সবুজ জঙ্গল আর পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে এর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করলাম।

ডিমনা লেকের অপূর্ব সৌন্দর্যের রূপরেখা ধরে দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে টাটানগরীর ইতিউতি ঘুরে যখন আবার ফেরার পথে রওনা দিলান, তখন কালো মেঘ তার সজল ঘন ছায়ার চাদর বিছিয়ে হাজির হয়েছে। গাঢ় সবুজ পাহাড়ের রূপরেখা নিকশ কালো মেঘের প্রেক্ষাপটে একাকার হয়ে যেন কোনও মহাপ্রলয়ের সংকেত বয়ে নিয়ে আসছে।দেখতে দেখতে দলমা পাহাড়ে বৃষ্টি নামলো। প্রবল ঝড়ের বিক্ষিপ্ততার পরে গাছগুলো যেন অপার আনন্দে বৃষ্টির শীতল জলে হাত পা ছড়িয়ে সারাদিনের ক্লান্তি জুড়িয়ে নিল। সকালবেলায় যারা গোরুছাগলের দল নিয়ে বেরিয়ে ছিল, আকস্মিক বৃষ্টিতে তারা সব দলছুট হয়ে গেছে। ঘন ঘন বিদ্যুতের ঝলকানিতে মেঘরাজ পাহাড়ের উপর থেকে পাহাড়ে তার উপস্থিতির সদর্প ঘোষণা করছিল। আমাদের গাড়ির ড্রাইভার সেই প্রবল বৃষ্টির মধ্যে দৃশ্যমানতা কমে আসায় একটি ছোট্ট গ্রামের পাশে কিছুটা নিরাপদ স্থান দেখে গাড়িটাকে কিছুক্ষণের জন্য দাঁড় করিয়ে দিল।

ক্রমান্বয়ে প্রবল বৃষ্টি, মেঘের গর্জন ও আলোর ঝলকানিতে আমিও নিরাপদে বাড়ি ফেরার ব্যাপারে শঙ্কিত হয়ে পড়লাম। গাড়ির কাঁচ বেয়ে গড়িয়ে পড়া জলের ফোঁটাগুলো সব ঝাপসা করে দিয়েছে। বৃষ্টি একটু কমতে গাড়ির জানলার কাঁচ হাত দিয়ে মুছে বাইরে তাকাতেই আমার চোখ খুব কাছেই একটি ছোট্ট মাটির বাড়ির একফালি দাওয়াতে আটকে গেল। আজ সকালের এই দলগুলোর কোনও একটি সেখানে আশ্রয় নিয়েছে। বৃষ্টিতে ওদের সাজপোশাক ছিন্নবিচ্ছিন্ন, ভেজা শরীরের সঙ্গে লেপটে আছে। ময়ূরের পালকগুলি ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। খুব জড়সড় হয়ে ওরা বৃষ্টি থেকে বাঁচবার চেষ্টা করছে, চোখেমুখে ক্লান্তির ছাপ সুস্পষ্ট, শূন্য দৃষ্টিগুলো শুধু অবিরাম বৃষ্টি মেপে চলেছে। তাদের নীরব উপস্থিতি ও নিস্তব্ধতায় বুঝতে বাকি থাকে না যে আজ বোধহয় আর পূজা হবে না। ঝড়বৃষ্টি অন্য অনেক কিছুর সঙ্গে তাদের আনন্দের আয়োজনটুকুও ধুয়ে উড়িয়ে নিয়ে গেছে অনেক দূরে কোনও নিরুদ্দেশের ঠিকানায়।

পাহাড়ের সজল ঘন ছায়ার চাদর ততক্ষণে চারদিক ছেয়ে ফেলেছে। বহুদূরে কলকাতায় মণ্ডপে মণ্ডপে যখন আলোর রোশনাই আর মানুষের ভিড়ে কোলাহলে শারদীয়া উৎসব প্রাঙ্গন মুখরিত, তখন দলমা পাহাড়ের কোলে নিশ্ছিদ্র অন্ধকার ও নিস্তব্ধতার মাঝে শুধু অবিরাম বৃষ্টির ঝরঝর শব্দ। অন্ধকারের হাত ধরে বৃষ্টি তার সখ্যতা বাড়িয়ে চলেছে। কাঁচের জানলা দিয়ে আমার দৃষ্টিও ক্রমশ ঝাপসা হয়ে এল, কিন্তু তা কাঁচের গা বেয়ে নেমে আসা জলে না আমারই চোখের জলে তা বুঝতে পারলাম না।