ঘুরে-ট্যুরে

সবাই চাইছিল, রাতটা যেন দীর্ঘায়িত হয়

By admin

October 03, 2020

(দ্বিতীয় পর্ব)

অমিতাভ ত্রিবেদী। ছবি: প্রতিবেদক

ভোররাতে আমাদের আট বন্ধুর মধ্যে ছয়জন বেড়িয়ে পড়ল টিকিট কাউন্টারে লাইন দেবার জন্য। আমরা বাকি দুই বন্ধু বাকিদের ব্রেকফাস্ট করিয়ে সেই বাসে করে ফরেস্ট গেটে গিয়ে মিলিত হলাম ওদের সাথে। ওই ছয়জনকে ব্রেকফাস্ট করিয়ে অপেক্ষায় রইলাম জিপ সাফারির। অতঃপর আমাদের পুরো টিমের চারটি জিপে শুরু হলো জিপ সাফারি। ঘন জঙ্গলের মধ্যে ঘন্টা দেড়েক ঘুরলাম। হাতি, গন্ডার, ময়ূর দেখলাম বটে। কিন্তু খানিকটা আশাহত হলাম, কারণ ‘ ইয়ে দিল মাঙ্গে মোর।’ পরদিন আমাদের পরবর্তী গন্তব্য চিলাপাতা ফরেস্ট।সকাল বেলা মাদারিহাট থেকে ব্যাগপত্তর গুটিয়ে চিলাপাতা ফরেস্ট সংলগ্ন একটি কটেজে উঠলাম। বেশ ভালো ব্যবস্থাপনা। মনের মানুষ চলচ্চিত্রের শুটিং এর সময় অভিনেতা প্রসেনজিৎ ও পাওলি দাম এখানেই ছিলেন।

সেদিন মধ্যাহ্ন ভোজ সেরে আমরা বেড়িয়ে পড়লাম জিপ সাফারি করতে চিলাপাতা ফরেস্টে। এই ফরেস্টও জলদাপাড়া অভয়ারণ্যের অন্তর্গত।  একটি নদী দুটি ফরেস্টকে বিভক্ত করেছে। পড়ন্ত বিকেলে মেন্দাবাড়ি জঙ্গল ক্যাম্প থেকে শুরু হলো জিপ সাফারি। এই জঙ্গলের ঘনত্ব বেশ। দিনের বেলাও মাটিতে সূর্যের আলো পৌঁছায় না বহু এলাকায়। প্রচূর ময়ূর চোখে পড়লো। সারি সারি গাছপালা, মাঝখান দিয়ে পিচের সরু রাস্তা দিয়ে আমাদের চারটি জিপ মসৃণ ভাবে সম দূরত্ব বজায় রেখে এগিয়ে চলেছে।সবার সজাগ দৃষ্টি। হঠাৎ গাড়ি ব্রেক কষল । গাইড সবাইকে চুপ করে সামনে তাকাতে বলল। দেখলাম হাতির দল সারিবদ্ধভাবে রাস্তা পারাপার করছে। এমন দৃশ্য দেখে মনটা খুশিতে ভরে গেল। এরপর এগিয়ে চললাম নল রাজার গড়ের দিকে। যেতে গিয়ে চোখে পড়ল বাইসন। পথিমধ্যে গাইড এক জায়গায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে একটি গাছকে দেখিয়ে বললেন এই গাছকে আঘাত করলে রক্ত ধারা বয়। আশ্চর্য হলাম, সত্যি দেখলাম লাল রঙের নির্যাস বেড়োতে। এমন নাকি তিন চারটি গাছই আছে এবং তার চিহ্নও বহন করছে। তারপর নল রাজার দূর্গ। দূর্গ বলতে তেমন কিছু এখন আর অবশিষ্ট নেই। ভাঙ্গা চোরা দেওয়ালে জঙ্গল আর শুধু একটা ঢিবি মতন আছে। ভাবতেই অবাক লাগছিলো এখানে কোনো এক সময় রাজা থাকতেন। চিলাপাতা জঙ্গলের ঘনত্বের জন্য এখানে খুব তাড়াতাড়ি অন্ধকার নেমে আসে। অন্ধকার জঙ্গলের বুক চিড়ে আমরা নি:শব্দে এগোতে থাকলাম। ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, বাইসনের জ্বলজ্বল চোখ, জোনাকির আলো ও বিভিন্ন রকম অজানা আওয়াজ হিমশীতল পরিবেশকে আরও রোমহর্ষক করে তুলেছিল। কল্পনা করতে লাগলাম জঙ্গলবাসীরা আমাদের দুর থেকে লক্ষ্য রাখছে, হয়তো বা বিরক্ত হচ্ছে।

এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে ফিরে এলাম কটেজে। এই রাতই আমাদের ডুয়ার্স ভ্রমণের অন্তিম রাত। তাই একে স্মরণীয় করে রাখতে ব্যবস্থা করা হয়েছিল ক্যাম্প ফায়ার এবং আদিবাসী নৃত্য। তাদের নৃত্যের তালে আমরাও নাচলাম। নাচলাম, গাইলাম লোকনৃত্য-লোকসঙ্গীত। আদিবাসীদের নৃত্যের পরেও আমাদের ক্যাম্প ফায়ার জ্বলতে থাকলো। তাতে চিকেন রোস্ট করে খাওয়ার স্বাদই আলাদা। শেষ রাতটা সবাই মিলে উপভোগ করলাম। চাইছিলাম রাত যেন আরো দীর্ঘ হয়। কিন্তু ছোটোদের কথা ভেবে বিরত হতে হল। সত্যি ওই রাতের আনন্দ ছোটো বড়ো সকলের স্মৃতিতে অমলিন হয়ে থাকবে। গভীর রাতে অনেক কুকুরের ডাকে ঘুম ডাঙলো, শুনতে পেলাম হাতির গর্জন।সে এক রোমহর্ষক আওয়াজ।কিন্তু উঠে পড়েও কোনো এক অজানা আতঙ্কে দরজা খুলে বেরোবার সাহস হলো না। এখন খুব আফসোস হয় সেই রাতের কথা ভেবে।

সকাল হল ময়ূরের কেকা  ডাকে। চারিদিকে ময়ূরের বিচরণ আমাদের তথা ছোটোদের মন ভরিয়ে দিল। এবার ফেরার পালা। বিষাদ গ্রস্ত মনে ব্যাগপত্তর গুছিয়ে সকাল সকাল ডাল-ভাত খেয়ে শেষ বারের মতো আমাদের পুরো ভ্রমণে চলার সাথী সেই বাসে করে চিলাপাতা ফরেস্টকে বিদায় জানিয়ে , ডুয়ার্সের জঙ্গলকে দুরে ছেড়ে এগিয়ে চললাম নিউ আলিপুরদুয়ার স্টেশনে। স্টেশনে পৌঁছে বিদায় জানালাম বাস ড্রাইভার ও তাঁর সহকারীকে। এই কদিনে তারাও আমাদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গিয়েছিল। তিস্তা তোর্সা এক্সপ্রেসে চড়লাম  দুপুর বেলা ,পরদিন কাকভোরে নৈহাটি নামতে হবে। উত্তরবঙ্গকে বিদায় জানিয়ে সুখস্মৃতি সঞ্চিত করে ফেরার পথে ছোটোদের একসাথে শেষ বারের মতো সময় কাটাতে দেখে মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল। ওই দিন ট্রেনে রাত বারোটার সময় জন্মদিন পালন হল, কেক কাটা হল আমাদের এক বন্ধু পত্নীর জন্মদিন উপলক্ষে।

ভোর বেলা বছরের শেষ সূর্যোদয়ের পূর্বে নৈহাটি স্টেশনে নেমে সবাই সবাইকে বিদায় ও আগত নতুন বছরের শুভকামনা জানিয়ে নিজ নিজ বাড়ির পথে প্রস্থান করলাম। ঠিক সূর্যোদয়ের সময় বাড়ি ঢুকলাম আর অজান্তেই কপালে হাত উঠে গেল সূর্যদেবকে প্রনাম করার জন্য। ধন্যবাদ জানালাম পরম ঈশ্বরকে, সুস্থ শরীরে সুস্থ মনে বাড়ি ফিরতে পারার জন্য।

(শেষ)