এক নজরে

বাংলাদেশের ডায়েরি

By admin

April 03, 2024

ষষ্ঠ পর্ব

আজ উৎসবের প্রস্তুতি ছাড়া অন্য কোন কাজ নেই, আর কাজের বেলায় আমি নিতান্ত অকর্মা। একটু এদিক ওদিক কোথাও ঘুরে আসার ইচ্ছে প্রকাশ করতে, নিখিলবাবু ব্যবস্থা করে দিলেন। বুঝিয়ে দিলেন রাস্তাঘাট, কিছু পরামর্শও দিয়ে দিলেন। অবশ্য দুলালও সৌরভ বলে একজনকে ধরে তার বাইক যোগাড় করে রেখেছিল। সেই বাইক নিয়ে, আমরা অর্থাৎ দুলাল ও আমি  বেরিয়ে পড়লাম কাছাকাছির মধ্যে বাগেরহাটের সাত গম্বুজা আর হজরত খানজাহান আলীর দরগার উদ্দেশ্যে। কুয়াশার চাদর সরিয়ে তখন ঝকমকে সোনালী রোদের হাসি। ঘন নিবিড় গাছপালার মধ্যে মসৃণ রাস্তা। আমরা প্রথমেই চলে এলাম খানজাহান আলীর দরগায়। হজরত খানজাহান আলি ছিলেন একজন মুসলিম ধর্ম প্রচারক এবং বাংলাদেশের বাগেরহাট অঞ্চলের স্থানীয় শাসক। ১৩৬৯ খ্রিষ্টাব্দে দিল্লির এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে তাঁর জন্ম। খানজাহান আলীর পিতার নাম আকবর খাঁ এবং মাতা ছিলেন আম্বিয়া বিবি। অনুমান  করা হয় যে তাঁর পূর্বপুরুষেরা ছিলেন তুরস্কের অধিবাসী। মেধাবী  খানজাহান আলির প্রাথমিক শিক্ষা তার পিতার কাছে শুরু হলেও তিনি উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করেন দিল্লির বিখ্যাত ওয়ালি এ কামিল পীর শাহ নেয়ামত উল্লাহর কাছে। ১৪১৮ খ্রিষ্টাব্দে যশোরের বারবাজারে খানজাহান আলীর অবস্থান কালে বাংলার দক্ষিণ পশ্চিম অংশে ইসলাম ধর্মের প্রচার ও প্রসার ঘটতে থাকে। শাসক খানজাহান আলী খলিফত-ই-আজাদ নামকরণ করে দুর্গম বাগেরহাট অঞ্চলে এক নতুন জনপদ সৃষ্টি করেন। সে সময়ে এ অঞ্চলে ৩৬০জন আউলিয়ার আগমনের সংখ্যার সাথে মিল রেখে  ৩৬০টি মসজিদ ও  ভাটি অঞ্চলে পানীয় জলের জন্য ৩৬০টি দীঘি খনন করেছিলেন।

বাগেরহাটের বিখ্যাত খাঞ্জেলী দীঘির উত্তর পাড়ে রয়েছে তাঁর সমাধি। এই সমাধি সৌধের ভেতরে পাথরের বেদিতে রয়েছে হজরত খানজাহান আলীর মাজার। এই মাজার দেখতে দেশ বিদেশ থেকে প্রায় প্রতিদিন এখানে ভিড় করেন শয়ে শয়ে মানুষ।  প্রতি বছর ২৫শে অগ্রহায়ণ খানজাহান আলীর মাজারে বার্ষিক ওরশ মোবারক হয়। চৈত্র মাসের প্রথম পূর্ণিমায় এখানে বসে মেলা। এই ওরশ আর মেলায় হয় লক্ষাধিক ভক্ত সমাগম।কি সুন্দর শান্ত স্নিগ্ধ জায়গা। এই দীঘির আয়তন প্রায় ২০০ একর। দিঘি  খনন করার পর যাতে কেউ দিঘির জল নষ্ট করতে না পারে সেজন্য খানজাহান আলী নাকি দিঘিতে এক জোড়া মিষ্টি জলের কুমির ছেড়ে দিয়েছিলেন। তাদের নাম ছিল কালাপাহাড় ও ধলাপাহাড়। বংশ পরম্পরায় কুমিরগুলো এই দিঘিতেই  বসবাস করে আসছিল। পরে বিভিন্ন কারণে এই কুমিরগুলির মৃত্যু হয়। হয়তো মানুষের সীমাহীন লোভ তাদের বাঁচতে দেয়নি। এমন অভিযোগও নাকি রয়েছে, এক শ্রেণীর অসৎ খাদেমেরা কুমিরের জন্য বরাদ্দ খাবারের অধিকাংশই বিক্রি করে দিত বাজারে। খাজাহান আলীর মতো প্রজারঞ্জক সাধক শাসকের মাজারেও চলছে আবাধে লোক ঠাকানো। একটু নরম সরম কাউকে পেলেই চাদর চড়ানোর নাম করে তাদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হছে টাকা। এমন জুলুমের মধ্যে আমাকেও পড়তে হয়েছিল। কিন্তু শুধু আফসোস করা ছাড়া আমাদের মতো সধারণ পর্যটকদের কিইবা করার আছে।

খানজাহান আলীর আর এক অন্যতম কীর্তি হলো বাগেরহাটের ষাট গম্বুজা মসজিদ। এই মসজিদের গায়ে কোনো শিলালিপি নেই। তাই সঠিক ভাবে বলা যায় না এটি জাহান আলীরই কীর্তি বা কোন সময়ে নির্মিত হয়েছিল। তবে মসজিদটির স্থাপত্যশৈলী দেখে অনেক ঐতিহাসিক অনুমান করেন পীর খান জাহান আলী ১৫শ শতাব্দীতে বহু বছর ধরে ও বহু অর্থ ব্যয় করে নির্মাণ করেছিলেন এই মসজিদ। পাথরগুলো আনা হয়েছিল রাজমহল থেকে। এটি বাংলাদেশের মাত্র তিনটি বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের মধ্যে একটি। ইউনেস্কো ১৯৮৫ সালে এই মসজিদ সহ বাগেরহাট শহরটিকেও ঐতিহ্যবাহী স্থানের মর্যাদা দেয়। মসজিদের নাম ষাট গম্বুজ হলেও গম্বুজের সংখ্যা আসলে ৭৭টি। মিনারের চারটি গম্বুজ যুক্ত করলে মোট গম্বুজের সংখ্যা দাঁড়ায় ৮১টি। ষাট গম্বুজ নামকরণ নিয়ে কিছু জনশ্রুতি রয়েছে, সাতটি করে সারিবদ্ধ গম্বুজ আছে বলে এই মসজিদের নাম ছিল আসলে সাত গম্বুজ। হয়তো মানুষের মুখে মুখে সাত থেকে ষাট হয়ে গেছে। আবার কেউ কেউ মনে করেন, গম্বুজগুলো ৬০টি স্তম্ভের ওপর অবস্থিত বলে ষাট খাম্বা কালে কালে ষাটগম্বুজ হয়ে যায়। কথিত আছে শাসক খানজাহান আলী তাঁর বৈঠক করার জন্য একটি দরবার হল গড়ে তোলেন, যা পরে ষাট গম্বুজ মসজিদ হয়ে ওঠে।

দোকান-দানিতে যেসব খাবার দাবার বিক্রি হচ্ছে তার সঙ্গে আমাদের এই বাংলার খাবার দাবারের চেহারার সঙ্গে মিল রয়েছে ১৬ আনা। স্বাদে হয়তো কিছু পার্থক্য রয়েছে, কিন্তু  সেসব পরখ করার খুব একটা সুযোগ ঘটেনি। ষাট গম্বুজায় এসে রাস্তার পাশে টাঙানো একটা নতুন জিনিস দেখলাম। অনেকটা কলার কাঁদির মতো দেখতে আকারে খানিকটা ছোট ধুসর রঙের কিছু। অনেকেই দেখলাম তার শাঁস খাচ্ছেন। কৌতুহলী হয়ে আমরাও খেলাম। খেতে অনেকটা আমাদের কিছুটা শক্ত হয়ে যাওয়া তাল শাঁসের মতো। এগুলো নাকি হেতাল গাছের ফল, সুন্দরবনের নোনা জলের পাশে এই হেতালের এন্তার জঙ্গল রয়েছে। এই হেতালের জঙ্গলেই নাকি গা ঢাকা দিয়ে থাকে দক্ষিনরায়। পৃথিবীর বিস্ময় বাংলার বাঘ। যাকে আমরা বলি রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার। সুর্য ডোবার আগেই আগামীকালের উৎসবের প্রস্তুতি প্রায় শেষ। শুধু রং-তুলি হাতে কাজ শেষ হয়নি বাবলু বিশ্বাসের। যিনি আগামীকালের উৎসব মঞ্চ সাজানোর মূল দায়িত্বে রয়েছেন। ছোটখাটো চেহারার এই মানুষটির কি অদম্য প্রাণশক্তি। গতকাল জেগেছেন প্রায় সারা রাত্তির, এখনো তিনি রংতুলি নিয়ে সচল। মনের মতো না হলে তিনি ছাড়বেন না। বাবলুবাবু হাতে শুধু তুলি ধরেন না ধরেন বাঁশিও। আগামীকালের সমবেত যন্ত্র সঙ্গীতে রয়েছে ওঁর বড় ভূমিকা। তাই মাঝেমধ্যে তুলি ছেড়ে বাঁশি হাতে নিতে হচ্ছে ওঁকে। অংশ নিতে হচ্ছে সমবেত যন্ত্র সংগীতের মহড়ায়।

দুপুর থেকেই দেখছিলাম পাড়ার মহিলারা বাড়ি থেকে আনা ‘কুরনি বঁটি’তে নারকেল কুরে জড় করে রাখছেন। সন্ধ্যার পর থেকেই তাঁরা সারি সারি কাঠের আগুন জ্বালিয়ে মাটির পাত্রে লেগে গেছেন পিঠে বানাতে। এসব নাকি আগামীকালের জল খাবারের প্রস্তুতি। চিতুই পিঠে আর টাটকা খেজুর গুড়। বানাতে হবে অনেক, ৩০০ জনের জন্য মাথা পিছু যদি মাত্র দুটিও ধরা হয় তবে অন্তত ৬০০। আর জিনিসটা যখন পিঠে, তবে হাতে হাতেই হয়তো উঠে যাবে অর্ধেক। যা পিঠে বানানোর সময় নিজের চোখে দেখলাম। তাহলে  সংখ্যাটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে সে চিন্তা আপনারাই করুন। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে সত্যিই আমি কল্পনা করত পারছিলাম না এমন জল খাবারের আয়োজনের কথা ভাবা সম্ভব। এটা কোনো শহুরে লোকদেখানো পিঠেপুলি উৎসব নয়। লোক সংস্কৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে খাবারের আয়োজন। দুপুরে অনেক লোকের ভিড়ের মধ্যে ঠিক খেয়াল রেখে দু’বোন পলি’ ও বৃষ্টি ( মজুমদার) আমাকে ডেকে যত্ন করে খাওয়ালেন। পরিচয় করিয়ে দিলেন এক অজানা জিনিসের সঙ্গে। বাংলাদেশে বিশেষত খুলনা ও যশোর অঞ্চলে রান্নার সঙ্গে চই বা চুই ঝাল বলে একটি লতানো গাছের কান্ড ব্যাবহার করা হয়। মাছ, মাংস, বিভিন্ন তরকারি, ডাল এমনকি চাটনিতেও এঁরা ব্যবহার করেন এই চই ঝাল। গাছটি দেখতে নাকি আমাদের পান গাছের মতো শুধু কান্ডটি হয় মোটা। পাতাসহ কান্ডের অংশ কেটে রোপণ করলে সহজেই নাকি চই ঝালের গাছ বেঁচে যায়। দেশে বিদেশে, মাঠেঘাটে এখনো কত এমন মা-বোনেরা ছড়িয়ে রয়েছে। যাদের জন্য পৃথিবীটা আজও সুন্দর।

মুরলী লোক সংস্কৃতি বিকাশ ও গবেষণা কেন্দ্রের এই গুরু শিষ্য সুহৃদ মিলন মেলা নিয়ে আলাদা করে বিষদে গেলাম না। আর পাঁচটা উৎসবের মতোই এই উৎসব।  আলাদা শুধু তার ভাবে ও ভাবনায়। সারিবদ্ধভাবে সাজানো হয়েছে বিভিন্ন লোক বাদ্যযন্ত্র আর সেগুলো বানানোর একেবারে প্রাথমিক পর্যায় থেকে অন্তিম পর্যায় পর্যন্ত। কেউ যদি এগুলো ভালো করে লক্ষ্য করেন তাহলে সহজেই তাঁর বোধগম্য হয়ে যাবে এই বাদ্যযন্ত্র বানানোর পদ্ধতি। বিভিন্ন স্কেলের বাঁশি বানাতে লাগে এক বিশেষ ধরনের বাঁশ। যা আমাদের এলাকায় পাওয়া যায় না। আমদানি করতে হয় সেই অসম কিংবা ত্রিপুরা থেকে। সেই বাঁশের চাষ এখানে অর্থাৎ এই ফকিরহাটে শুরু করেছেন নিখিলবাবু। চুপিচুপি আর একটা কথা বলে রাখি নিখিলকৃষ্ণ মজুমদারের নিজের হাতে বানানো বাঁশি এখন বাজাচ্ছেন পন্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া। তাঁর পরিচয় নিশ্চয়ই নতুন করে দিতে হবে না।

সব কিছুরই শেষ হয়, হয়তো বেশ কিছুদিন থেকে যায় তার রেশ। এই কয়েক দিনের বাংলাদেশ সফরের রেশ আমার কাছে থেকে যাবে বহুদিন। কত চরিত্রের সঙ্গে আলাপ হলো তাঁদের অনেকের কথা আমার স্মৃতিতে জ্বলজ্বলে হয়ে থাকবে। অনেকের অনেক অনুরোধ ছিল আর কটাদিন থেকে যাই। আমি কিন্তু সে পথে হাঁটার চেষ্টা করিনি। আমার মনে হয় সুন্দরকে দেখতে হয় একটু তফাতে, চাইলে একটু ছোঁয়া যায় কিন্তু জড়িয়ে ধরতে নেই। উৎসবের রাতেই রওনা দিয়েছি খুলনা। রাতটুকু ওখানে কাটিয়ে সকাল সকাল শুরু হবে ঘরে ফেরার গান।

(শেষ)