এক নজরে

বাংলাদেশের ডায়েরি

By admin

March 14, 2024

তৃতীয় পর্ব 

স্টেশন চত্বরে বেশ ভিড় রয়েছে, আর যখন অন্য কোনো ট্রেন নেই সুতরাং এরা সবাই আমার সহযাত্রী। বেশ কয়েকজন চেনা মুখ চোখে পড়লো, যাঁরা সবাই আমাদের সঙ্গেই সীমান্ত পেরিয়ে এসেছেন। সবার সঙ্গেই হাসি বিনিময় হলো, অধিকাংশই তাঁদের বাড়িতে আমন্ত্রণ জানালেন। সিট পাবো কিনা তা নিয়ে একটু সংশয় ছিল, ভরসা একটাই ট্রেনের যাত্রা শুরু এখন  থেকেই। এখানে যাত্রীদের ওঠা নামার জন্য একটা মাত্র প্লাটফর্ম যে ট্রেনটা আসে সেটাই ফিরে যায়। বাদবাকি যে সব লাইন পাতা রয়েছে সেখানে যাতায়াত করে শুধু মালগাড়ি। নির্ধারিত সময়ের বেশ কিছুটা আগেই ট্রেন এসে গেল। কামরায় বেশ ভিড়, প্লাটফর্মেও  ভিড় ছিল কিন্তু হুড়োহুড়ি না করেও সিট পেয়ে গেলাম সহজেই। প্রায় মান্ধাতার আমলের ট্রেন, বোঝাই যায় খুব একটা সংস্কার হয় না, তবে অপরিচ্ছন্ন নয়। ঝপাঝপ গাড়ির প্রায় সমস্ত সিটের নিচে আর বাঙ্কের অনেকটাই বোঝাই হয়ে গেল ভারত থেকে আসা চোরাই মালে। ট্রেনও বোঝাই হয়ে গেল মানুষে। এক্কেবারে কাঁটায় কাঁটা মিলিয়ে ট্রেন ছাড়লো। চোরাচালানকারী দের জন্য খানিকটা ক্ষোভ থাকলেও খুব একটা বিরোধ নেই সাধারণ যাত্রীদের। বেশ খানিকটা দুলতে দুলতে ট্রেন ছুটে চলছে কারো বাড়ির উঠোন ছুঁয়ে, কারো পুই মাচা বেগুন খেতের পাশ দিয়ে। আমাদের গ্রাম বাংলার সঙ্গে একটুও পার্থক্য নেই।

সত্যি ভাবতে অবাক লাগে একই ভাষায় আমরা কথা বলি, একই রকম আমাদের গালিগালাজ। হয়তো একই রকম স্বপ্ন দেখি। সময় মেপে একই সঙ্গে শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা আসে। গাছগাছালি পাখপাখালি, পোশাক আশাক সবই এক কিন্তু দেশটা আলাদা। সেই আলাদা দেশের একই কোলাহলে একই চেহারার লোকজনের সঙ্গে গল্প করতে করতে আমরা এগিয়ে চলেছি খুলনার দিকে। আমার উল্টো দিকের সহযাত্রী নামবেন সামনের নাভারন স্টেশন পেরিয়ে ঝিকরগাছায়। অর্থাৎ দু’নম্বর স্টেশন। নামে মাত্র দুটি হলেও দূরত্ব বেশ খানিকটা। আমাদের ওদিকের রেল স্টেশন হলে অন্তত খান দশেক। ভদ্রলোক এখন আসছেন ‘রানাঘাট’ থেকে, সেখানে তাঁদের অনেক আত্মীয় থাকেন। একসময় তাঁর ছেলেবেলায় তাঁরাও নাকি অনেকের সঙ্গে দেশ ছেড়ে ছিলেন, পরে আবার ফিরে আসেন বাংলাদেশে নিজেদের ভিটেয়। এখন সপরিবারে ভালোই রয়েছেন। চাষবাস আর বাড়িতে ছোট্ট একটা মুদিখানার দোকান চালিয়ে তাঁর বেশ চলে যায়। সঙ্গে বেশ বড় এবং ভারী দুটি ব্যাগ, জানালেন ভারতে যখন এসেইছেন তখন ফেরার সময় সঙ্গে নিয়েছেন দোকানের কিছু মালপত্র এবং পরিবারের প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস। ওঁরই কাছে শুনলাম আগের চোরা চালানের বৃত্তান্ত। ভদ্রলোক খুব আন্তরিক ভাবেই তাঁর বাড়িতে আমন্ত্রণ জানালেন, এমন যুক্তিও খাড়া করলেন, “আরে দাদা বেড়াতেই তো আসা। তবে এক’দু রাত আমার বাড়িতে কাটিয়ে গেলে ক্ষতি কি? হয়তো তেমন খাতির করতে পারবো না, তবে কথা দিচ্ছি অযত্নও হবে না”। সত্যি বলছি এমন আমন্ত্রণে অভ্যস্ত ছিলাম না, তাই খানিকটা থতমত খেলাম। খুব লোভও হচ্ছিল যেতে কিন্তু আমি নাচার, সময় যে আমার মাপা। নাগরিক ব্যাস্ততা আমাদের পাকে পাকে জড়িয়ে রেখেছে। জানি হয়তো কোনদিনই ফোন করবো না, তবুও পরের বার ঠিক দেখা হবে বলে ফোন নাম্বার নিয়ে রাখলাম। ভদ্রলোক আমাদের শুভেচ্ছা জানিয়ে নেমে গেলেন তাঁর নির্দিষ্ট স্টেশনে।

ট্রেনে এখন বেশ চাপাচাপি ভিড়। সামনেই দাঁড়িয়ে রয়েছেন এক মধ্যবয়স উত্তীর্ন প্রবীণা। ইচ্ছে থাকলেও নিজের সিটটা তাঁকে ছাড়তে পারলাম না। ভদ্রমহিলা যাবেন আমাদের মতোই একেবারে শেষ অর্থাৎ খুলনা পর্যন্ত। সেখানেই থাকেন একটা ফ্ল্যাটে। জানতাম বাংলাদেশেও কিছু কিছু আমাদের ওখানকার মত ফ্ল্যাট নামক সভ্য বস্তি গজিয়ে উঠেছে, সেটা খুলনাকেও গ্রাস করেছে এমনটা জানতাম না। ঢাকায় কি হয়েছে জানিনা তবে খুলনা পৌঁছে দেখেছি ওই সভ্য বস্তি অন্তত আকাশ ছোঁয়ার স্পর্ধা দেখায়নি। একটা অদ্ভুত ব্যাপার চোখে পড়লো এখানে, ওই অত ভিড়ের মধ্যেও টিকিট চেকার, তারা কেউই আমাদের এখানের মতো কালো কোট পরা নয়। গলায় অবশ্য একটা ব্যাজ ঝোলানো রয়েছে। কাউকে ফাইন করতে দেখলাম না, পয়সা নিয়ে রসিদ দিয়ে অনেকের টিকিট করে দিচ্ছেন। জিজ্ঞেস করে জানলাম এখানে টিকিট না কেটেও ট্রেনে উঠে পড়া যায়। ট্রেনের মধ্যে থাকা চেকারের কাছে নির্দিষ্ট মূল্য দিয়ে সংগ্রহ করে নেওয়া যায় টিকিট। কে কোন স্টেশন থেকে উঠেছে, কত টাকার টিকিট কাটছে, ফাঁকি দিচ্ছে কিনা, সেটা কিভাবে নির্ধারিত হচ্ছে বুঝতে পারলাম না। আসলে সবটাই নির্ভর করছে যাত্রীদের সততার উপর। যাত্রীরা নিশ্চয়ই সেভাবে ফাঁকি দেয় না তাই এমন ব্যাবস্থা চালু রাখা সম্ভব হয়েছে। সততার এমন নিদর্শন এরপর বহুবার পেয়েছি, সে গল্প যথাসময়ে।

আমাদের ট্রেন যশোর পোঁছে গেল, ট্রেনে এখন হাঁসফাঁস করা ভিড়। এখানে আমাদের কামরায় উঠে এল একদল তরুণ তরুণী, ওদের কথপোকথন থেকে জানলাম ওরা খুলনার আশপাশ থেকে যশোরে এসেছিল পিকনিক করতে। যশোর এখন তার ঐতিহাসিকতা কিংবা মাইকেল মধুসূদনের আবেগ ছাড়িয়ে বিখ্যাত হয়েছে ফুলের শহর হিসাবে। প্রশাসনিকভাবে শহরটি যশোর জেলা এবং যশোর সদর উপজেলায় ভাগ করা। যশোর  বাংলাদেশের প্রাচীনতম পৌরসভার একটি। ভৈরব নদের তীরে গড়ে ওঠা যশোরকে ফুলের রাজধানী বলা হয়, কেননা যশোরের গদখালি থেকে সাপ্লাই করা ফুলই নাকি সারা বাংলাদেশের ৮০ ভাগ ফুলের চাহিদা মেটায়। বিশেষত এখানকার গোলাপ নাকি দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও এক নম্বর স্থান করে নিয়েছে। বাংলাদেশের সব থেকে বড় স্থলবন্দর বেনাপোল যশোরের মধ্যেই। খুলনা থেকে এই যশোরের উপর দিয়েই অবিভক্ত বাংলায় বৃটিশ আমলের সম্পদ পাচার করার সবচেয়ে বড় রাস্তা তৈরি হয়েছিল কলকাতা পর্যন্ত। যা আজও যশোর রোড নাম নিয়ে দু’দেশের মধ্যেই ছড়িয়ে রয়েছে। সেসময় শুধু নয় আজও বাংলাদেশই হলো দু’বাংলার মধ্যে সবচেয়ে সম্পদশালী কৃষি ভান্ডার। সেসময় বৃটিশরা তাদের লুন্ঠন করা সমস্ত কৃষিজ সম্পদ অর্থাৎ কাঁচামাল বাংলাদেশ থেকে পাচার করতো কলকাতায় তারপর কলকাতার আশেপাশে সেসব প্রক্রিয়া করে চালান করতো তাদের দেশে। হাওড়া ও কলকাতার গঙ্গার ধারে তাই গড়ে উঠেছিল হাজার হাজার কারখানা। দেশ ভাগ হলো ওপার বাংলার কৃষি সম্পদ আসা বন্ধ হলো, বিশেষত পাট। ধীরে ধীরে ধোঁয়া ওঠাও বন্ধ হয়ে গেল এপারের কারখানার চিমনিগুলো থেকে। আজও সেসব অজস্র কারখানার কঙ্কাল দাঁড়িয়ে রয়েছে গঙ্গার দু’পারে। একই সঙ্গে ওপার বাংলায় কমে গেল পাটের চাষ, কারণ ওখানে বৃটিশরা তৈরি করেনি কোনো চটকল। আমাদের অদূরদর্শী রাজা সাজতে চাওয়া লোভী নেতারা কলকাতা আর হাওড়া নিয়ে হামলে পড়লো, কিন্তু বুঝতে পারলো না কলকাতা আর হাওড়ার প্রান ভোমরা থেকে গেছে ওপারে।

যশোর রোডের গুরুত্ব কিন্তু কমলো না। দু’বাংলার বানিজ্যিক লেনদেনের সবচেয়ে বড় ভরসা এই যশোর রোড। আগেই বলেছি এবার হাত পড়েছে যশোর রোডের ধারের শতাব্দী প্রাচীণ গাছগুলোর উপর। উন্নয়নের নামে যা লুন্ঠনের আর এক রূপ। আমরা সবাই  চেপেচুপে বসে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা প্রবীণাকে কোনোরকমে বসার জায়গা করে দিলাম। আমার কোলে উঠিয়ে নিলাম এক ফুটফুটে বাচ্চাকে, বাচ্চা তার মাকে ছাড়া বাবার সঙ্গে খুলনা পর্যন্ত আমার সহযাত্রী। মা ছাড়া কিংবা এই ভিড় দেখে বেশ মনমরা। আলাপ জমাতে অনেক চেষ্টা করেও সফল হলাম না। যশোর থেকে ওঠা তরুণ তরুণীর দলের কয়েকজনও এদিক ওদিক জায়গা করে নিয়েছে। তারা এবার বেশ বেসুরো গলায় গান ধরলো। বেসুরো হলেও খুব বিরক্তিকর এমন নয়। আসলে এটা যৌবনের উচ্ছ্বাস।

আমার পাশে জায়গা পাওয়া ওদেরই দলের এক তরুণের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। সে এর আগে একবার কলকাতা ঘুরে গিয়েছে। এখানকার ট্রেনে এই ভিড়ের কথা উল্লেখ করতেই তীব্র প্রতিবাদ জানালো, উদাহরণ দিল বনগাঁ লোকালের কথা। খুব সঠিক যুক্তি। “আমাদের এই লাইনে সারা দিনে মাত্র দুটি ট্রেন চলে আর আপনাদের বনগাঁ থেকে শেয়ালদার ট্রেন তো ১৫-২০ মিনিট অন্তর। আর বাংলাদেশে কতটা রাস্তায় ট্রেন চলে”? খুব সত্যি কথা। বাংলাদেশে প্রথম রেলপথ ১৮৬২ সালে ব্রিটিশরা শুরু করে। তখন বাংলাদেশের কোনো অস্তিত্ব ছিল না, বাংলাদেশ ছিল বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অধীনে। ওই বছরেই অবিভক্ত বাংলায় ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে দর্শনা রেলওয়ে স্টেশন থেকে জগতি স্টেশন পর্যন্ত রেলপথ চালু করে। ১৮৮৫ সালে নারায়ণগঞ্জ থেকে ময়মনসিংহ পর্যন্ত আরেকটি রেলপথ তৈরি হয়। তারপর কুমিল্লা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত শুরু হয় রেল চলাচল। এর দীর্ঘদিন বাদে ১৯১৫ সালে আখাউড়া থেকে টঙ্গীর রেলপথটি খোলা হয় যা শায়েস্তাগঞ্জকে হবিগঞ্জের সাথে যুক্ত করে। শায়েস্তাগঞ্জ থেকে বাল্লা পর্যন্ত আরেকটি লাইন তৈরি হয় ১৯২৯ সালে। ভারত ভাগের আগে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত যার সবই ছিল পাকিস্তান পূর্বাঞ্চলীয় রেলওয়ের অধীনে। বৃটিশ শাসিত অবিভক্ত ভারতে বৃটিশরা তাদের লুটপাটের স্বার্থে বর্তমান ভারতীয় ভুখন্ডে রেলের যে পরিকাঠামো তৈরি করে তার থেকে অনেক কম পরিকাঠামো তৈরি হয় নদী বহুল বর্তমান বাংলাদেশে। বাংলাদেশের মতো এতটা নবীন আর ছোট্ট দেশ, যাদের যুদ্ধের স্মৃতি এখনো দগদগে। যাদের প্রায় প্রতি বছরই প্রাকৃতিক দুর্যোগের মোকাবিলা করতে হয় তাদের রেল পরিষেবা খুব উন্নত মানের না হওয়াই স্বাভাবিক।

শেষ পর্যন্ত অনেকেই আমার সঙ্গে আলোচনায় যোগ দিলেন, বুঝলাম বয়সে তরুণ হলেও এরা কিন্তু বেশ খোঁজ খবর রাখে, আর দেশের জন্য রয়েছে বেশ খানিকটা আবেগ।

তথ্য সুত্র-

বাংলাদেশ রেলওয়ে, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ।

বাংলাদেশ রেলওয়ের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, বাংলাদেশ।

চলবে…