এক নজরে

বাংলাদেশের ডায়েরি 

By admin

March 01, 2024

প্রথম পর্ব

এর আগে বেশ কয়েকবার বাংলাদেশ যাওয়ার উদ্যোগ নিয়েছি কিন্তু বিভিন্ন কারণে ঘটে ওঠেনি। এবারেও এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, ভেবেছিলাম হয়তো এবারও ফস্কে যাবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত একরকম জিদ করে মাত্র কয়েক দিনের জন্য বাংলাদেশের উদ্দ্যেশ্যে পা বাড়িয়ে দিলাম। ইচ্ছা ছিল বাংলাদেশ যখন যাওয়া হচ্ছে তবে কয়েকদিন থেকে একটু এদিক ওদিক টহল দিয়ে আসবো। প্রথমে বাধ সাধল বাংলাদেশের ভোট, আমার যাওয়ার সময়টাতেই ভোটের দিন ঘোষণা করে দিল বাংলাদেশ সরকার। আর কাগজে যেসব খবর পড়ি বা সোশ্যাল মিডিয়ায় বাংলাদেশি বন্ধুদের যেসব পোস্ট দেখি তাতে বোঝা যায় যতই প্রকৃতি মোড়া সবুজ সুন্দর বাংলাদেশের ছবি দেখিনা কেন রাজনৈতিক ও মৌলবাদী হানাহানীতে বাংলাদেশ আমাদের দেশের চেয়ে একটুও পিছিয়ে নেই। ধর্মীয় বিদ্বেষের বিষে ওরাও জর্জরিত। বাংলাদেশি বন্ধু ও পরিচিত জনেরাও নিষেধ করলেন ভোটের সময় শুধু নয় কাছাকাছি সময়েও যেন বাংলাদেশে না থাকি।

কোথাও যেতে হলে বিশেষত বেড়াতে গেলে একটা উপলক্ষ এবং সঙ্গী লাগে। আমার সঙ্গীটি অর্থাৎ দুলাল হয়ে উঠলো আমার দ্বিতীয় বাগড়ার কারণ। অবশ্য দুলালের কিছুই করার ছিলনা দীর্ঘদিন কাজ হারিয়ে সদ্য একটা কাজে বহাল হয়েছে ও। তাই বড় ছুটি দেয়নি ওর নয়া মালিক। আর আমার দুলালের লেজ ধরার কারণটি হলো দুলাল আমার চেয়ে বেশি অভিজ্ঞ এবং নিখিলকৃষ্ণ মজুমদার যাঁর আমন্ত্রণে বাংলাদেশ আসা তিনি দুলালের গুরু। নিখিল বাবুর ‘মুরলী লোক সংস্কৃতি ও বিকাশ কেন্দ্র’-র বাৎসরিক অনুষ্ঠানেই আসা। এটাই আসল উপলক্ষ। তবে আমি সাধারণত কলা বেচলে রথও দেখে আসি। এবার ভোট আর এক্কেবারে সঙ্গীহীন হয়ে রথ দেখায় তেমন জমবে না বুঝেছি। আগামী মার্চে কুষ্টিয়ার ‘লালন মেলায়’ আসবো এমন কথা হয়েই আছে সুতরাং তার একরকম ওয়ার্ম আপ সেরে নেওয়া এই ঝটিকা সফরে। যাওয়া ও আসা দুটি বর্ডার পেরিয়ে লোকাল বাসে ট্রেনে রিক্সা নিয়েই সারবো ভেবেছি। কারণ এই লোকাল যাত্রায় লোকাল রাস্তাঘাট, লোকাল লোকজনের সঙ্গে আলাপ করা যাবে। অভিজ্ঞতায় জানি এসি শোভিত একটু উচ্চমার্গের ট্রেন হলে তাদের যাত্রীরা একটু স্বভাব গম্ভীর, তাঁরা যেচে আলাপ করা বা একটু বেশি কথা বলাকে অশিক্ষা ভাবেন। একটু বেশি কথা বলা আর গায়ে পড়ে আলাপ করার অশিক্ষাটি আমার রয়েছে ১৬ আনার উপর ১৮ আনা, তাই এমনই সিদ্ধান্ত।

ভেবে রেখেছিলাম আগের দিন বনগাঁয় রাত কাটিয়ে এক্কেবারে সকাল সকাল বর্ডারে হাজির হবো যাতে দুপুরের মধ্যেই গন্তব্যে পৌঁছে যাওয়া যায়। এক্ষেত্রেও দুলালের কারণে সে ভাবনা বাতিল করতে হলো। সেদিন আবার বিকাল থেকে শঙ্কা জাগালো পেট, হটাৎ করে সে বিদ্রোহ করায় ভাবলাম এবারেও বাংলাদেশ যাওয়ার বাড়া ভাতে ছাই পড়বে নাকি? শেষ পর্যন্ত ফোনে এক ডাক্তার বন্ধুর আশ্বাসে ও তার পরামর্শে কয়েকটা ওষুধ গিলে ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিলাম।

সকাল সাতটা দশের বনগাঁ লোকাল ধরবো এমন ভেবে ভোর সাড়ে চারটার ট্রেন ধরতে সেজেগুজে চলে এলাম স্টেশনে কিন্তু আমাদের সুসভ্য ভারতীয় রেল আমাদের এক ঘন্টার রাস্তা পার করতে লাগিয়ে দিল দু’ঘন্টা কুড়ি মিনিট। অবশ্য ট্রেনে এতটা সময় বাড়তি বসে থাকার জন্য বাড়তি একটি পয়সাও দাবি করেনি উদার ও মহানুভব ভারতীয় রেল। সুতরাং সাতটা দশের বনগাঁ লোকালকে আমাদের ভার বহন করতে হয় নি। আমাদের ছাড়াই সেদিন রওনা দিয়েছিল সে। আর আমরা শেয়ালদা স্টেশনে বেশ কিছুক্ষণ ঝিমিয়ে নিয়ে পরের আটটা পাঁচের ট্রেন ধরলাম। আটটা পাঁচ যদিও দশ মিনিট বাদে ছাড়লো কিন্তু ট্রেনে বেশিক্ষণ বসার সুযোগ না দিয়ে প্রায় নির্ধারিত সময়েই নামিয়ে দিল বনগাঁ।

বনগাঁ আমার কাছে এক অতি মধুর নাম। এর আগে বনগাঁর কাছাকাছি এলেও বনগাঁ আসা হয়ে ওঠেনি। বনগাঁ লোকালের অস্বাভাবিক ভিড়ের কথা আমাদের কাছে বনগাঁকে বিখ্যাত করে দিয়েছে। একটু শহর ছাড়িয়ে বুঝতে পারলাম বনগাঁ নামের স্বার্থকতা। শতাব্দী প্রাচীন বিশাল বিশাল গাছের সারি তার দু’পাশে মসৃণ রাস্তা, রাস্তার দু’দিকেই চোখ জুড়ানো সবুজ। শুনেছি এই শতাব্দী প্রাচীণ গাছগুলোর মৃত্যু ঘন্টা বেজে গেছে, অচিরেই এরা আমাদের উন্নয়নের বলি হবে। ইতিমধ্যেই যশোর রোডের অনেক গাছকে প্রাণ দিতে হয়েছে উন্নয়নের করাল থাবায়। হাজার আন্দোলন হাজার প্রতিবাদ তাদের মৃত্যু আটকাতে পারেনি। রাষ্ট্র নামক দানবটি যখন চায় তখন বনগাঁর গাছগুলোরও রোহাই নেই। বুঝেছি অচিরেই এখানে সবুজ উধাও হবে, চারিদিকে দম্ভের মতো মাথা তুলে দাঁড়াবে কংক্রিটের জঙ্গল।

টাকা পয়সা বদলা বদলি করে লাইনে দাঁড়িয়ে গেলাম সামনে তখন অন্তত হাজার জনের সর্পিল লাইন। মাথার উপর স্নেহের ছায়া মেলে দাঁড়িয়ে ওই গাছগুলো। ভাবতে চোখে জল আসছিল, এই গাছগুলো আর থাকবে না তার বদলে হয়তো একটা ছাউনি হবে কিন্তু কিছুতেই থাকবে না সেখানে গাছের স্নেহ শীতল স্পর্শ। মায়া ভরা হাতে স্পর্শ করে নিলাম ওই তরুবরের শরীর। হয়তো আগামী বার থাকবে না এই তরুবরেরা, মুখ থুবড়ে পড়ে থাকবে তাদের কঙ্কাল।

অবশেষে লাইন এসে গেল ভারতীয় বর্ডারের চেক পোস্টে তারপর হাজার অব্যবস্থার মধ্যে অহেতুক ঘন্টা দুয়েক আটকে থেকে বাংলা দেশের মাটিতে পা। বাংলাদেশের চেকপোস্ট খুবই পেশাদারী দক্ষতায় দ্রুত কাজ সারলো। পেটে তখন ছুঁচোর ডন মারা শুরু হয়ে গেছে। সেই কাক ভোরে এক কাপ চা আর মাঝ রাস্তায় রাজিবের পাঠানো কেকের একটা টুকরো ছাড়া আর কিছু পেটে ফেলার ফুরসৎ মেলেনি। বাংলাদেশ চেকপোস্ট যাদি ভারতীয় চেকপোস্টের মতো দাদাগিরী দেখাতো তবে পেটের ছুঁচো হয়তো বাইরে বেরিয়ে আসতো।

ক্রমশ…