%%sitename%%

ক্রাইম ডাইরি

খুনির শ্বাস আর জোহরার দীর্ঘনিঃশ্বাস

By admin

July 30, 2020

ইন্দ্রনীল বসু

জোহরা খাতুনকে মনে আছে?গার্ডেনরিচের ব্যবসায়ী পরিবারের বছর ষাটের সেই বৃদ্ধা, যাঁকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে খুন করা হয়েছিল? আজ ৬ বছর পরেও তার খুনিরা এখনো অধরা।ছয় বছর পিছিয়ে গিয়ে আগে জেনে নেওয়া যাক জোহরা খাতুন হত্যাকাণ্ডের যাবতীয় তথ্য।সাল ২০১৪, তারিখ ২৫ ডিসেম্বর। গার্ডেনরিচের রামনগরের বাসিন্দা জোহরা খাতুনের রক্তস্নাত দেহ উদ্ধার হয় তাঁরই ঘর থেকে। খবর পেয়ে পুলিশ সেখানে পৌঁছে দেখে, রক্তে ভেসে যাচ্ছে ঘর। বিছানায় শুয়ে বছর ষাটের বৃদ্ধা জোহরা খাতুন। অবশ্যই মৃত, রক্তস্নাত। বিছানার চাদর বা তাঁর পরনের কাপড় আসলে যে রঙেরই হোক না কেন, সে সবের রং তখন শুধুই লাল। ২৭ বার ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপানো হয়েছিল তাঁকে। ২৭ বার! নৃশংসতা, ভয়াবহতার কথা চিন্তা করে শিউরে উঠেছিল পুলিশও।এখানেই শেষ নয়, আততায়ীরা রেয়াত করেনি ১২ বছরের তাঁর নাতনিকেও। ১৫টি কোপে তাঁকে শেষ করার পুরো ব্যবস্থাই করেছিল খুনিরা। কিন্তু, রাখে হরি মারে কে! বরাত জোরে বেঁচে ওঠে ওই কিশোরী। খুনের সময় একই বিল্ডিংয়ে ছিলেন, তাঁর পরিবারের সদস্যরা। কিন্তু কেউই কিছু শুনতে পায়নি!

জোহরা খাতুনের নাতি ইমরান (নাম পরিবর্তিত) নিজের আদরের দাদিজানের কাছে রোজ সকালেই নানান বায়না নিয়ে হাজির হত। ব্যতিক্রম ঘটেনি সেদিনও। নয়টা নাগাদই ঠাকুমার ফ্ল্যাটের সামনে হাজির হয় ইমরান। সে দেখে কোলাপসেবল গেট খোলা। এমনকি কাঠের দরজাটিও যে খোলা। মেঝেতে পড়ে রয়েছে তালা। খটকা লাগে, অন্যান্য দিন তো দাদি এমনটি করে না! সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে ভেতরে ঢুকেই অজ্ঞান হওয়ার জোগাড় ইমরানের। চিৎকার করে ওঠে, সে সময়ে অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র ইমরান। তার চিৎকারে ছুটে ঘরে ঢোকেন পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা। দেখেন, রক্তে ভেসে যাচ্ছে শোয়ার ঘর। রক্তাক্ত অবস্থায় বিছানায় পড়ে জোহরা খাতুন ও তাঁর নাতনি।

পুলিশ উপস্থিত হলে তৎক্ষণাৎ জোহরা খাতুনের নাতনিকে পাঠানো হয় হাসপাতালে। ছুরির কোপে বৃদ্ধার মৃত্যু হলেও, প্রাণে বেঁচে যাওয়ার আশা ছিল তাঁর নাতনির। আর জোহরা খাতুনের দেহ পাঠানো হয় ময়নাতদন্তের জন্য।

পরে ময়নাতদন্তের রিপোর্টে জানা যায়, ভোর পাঁচটার পর খুন করা হয় বৃদ্ধাকে। মুখ ও ঘাড়েই ছিল ৯০ শতাংশ আঘাত। নৃশংসতার সীমা ছাড়িয়ে খুনিরা ভোজালি জাতীয় কোনও অস্ত্র দিয়ে বুক ও পেট চিরে দিয়েছিল। তা-ও উঠে এসেছিল রিপোর্টে। এখানেই শেষ নয়, তিনটি আঙুল, কব্জি কেটে দেওয়া হয়। শরীর থেকে আলাদা করে দেওয়া হয়েছিল একটি হাতের কনুই! কী এমন প্রবল আক্রোশ থাকতে পারে, যার জেরে এক বৃদ্ধাকে এতটা নৃশংসতার সঙ্গে হত্যা করা হতে পারে। এই প্রশ্নই বার বার ভাবিয়েছিল সবাইকে।

অন্য দিকে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন জোহরা খাতুনের নাতনির শরীরে মেলে ১৫টি ক্ষতচিহ্ন। সে সবই ছিল তাঁর মুখ-কান মিলিয়ে। ঘটনার একমাত্র সাক্ষী সে-ই।তদন্তে নেমে পড়ে গার্ডেনরিচ থানা, হোমিসাইড বিভাগ থেকে এসএসপিডির গোয়েন্দারা। রামনগরের চারতলা বিল্ডিংয়ের তিনটি ফ্ল্যাটে থাকত জোহরার পরিবার। একটি ফ্ল্যাটে নাতনিকে নিয়ে থাকতেন জোহরা। তার পাশে তিন কামরার ফ্ল্যাটে বৃদ্ধার বড় ছেলে রহমতুল্লা ও তার পরিবারের সঙ্গে একসঙ্গে থাকতেন মেজ ছেলে এহমতুল্লা ও ছোট ছেলে শামিম। তৃতীয় ফ্ল্যাটে থাকতেন জোহরার মেয়ে-সহ পরিবারের অন্য সদস্যরা।

জরির ব্যবসায়ী জোহরারা। পাশাপাশি ছিল সুদে টাকা ধার ও আর্থিক লেনদেনের কারবারও। তবে তদন্তে জানা যায়, বেআইনি ভাবে করা হত সেই ব্যবসা। এমনকি জোহরাও আর্থিক লেনদেনের ব্যবসায়ে সক্রিয় ভাবে যুক্ত ছিলেন। আর্থিক বিবাদই কী তাঁর মৃত্যু ডেকে আনে? এই প্রশ্নই ঘুরপাক খেয়েছিল তদন্তকারীদের মাথায়। পারিবারিক বিবাদের সম্ভাবনাকেও উড়িয়ে দেওয়া হয়নি। দফায় দফায় পরিবারের সদস্য, প্রতিবেশীদের জেরা করা হয়। উঠে আসে নানান তথ্য। একটি ফ্ল্যাট নিয়ে এক ছেলের সঙ্গে মন কষাকষির ঘটনাও সামনে আসে পুলিশের। তবে হত্যাকারী যে বৃদ্ধার পরিচিত, সেই অনুমান করেছিলেন তদন্তকারীরা। জোহরার ছোট ছেলে পুলিশকে জানান, ভোর পাঁচটা পর্যন্ত টিভি দেখেছিলেন তিনি। কিন্তু তা সত্ত্বেও কোনও কিছু শুনতে পাননি তিনি। একই কথা পরিবারের অন্য সদস্যদের মুখ থেকেও শোনা গিয়েছিল। এলাকাবাসীদের বয়ানেও বিশেষ কোনও সূত্র পায়নি পুলিশ। মেলেনি কোনও সিসিটিভি ফুটেজও।

এমন পরিস্থিতিতে পুলিশের শেষ ভরসা ছিল জোহরার ১২ বছরের নাতনি। সুস্থ হওয়ার পর চিকিৎসকদের উপস্থিতিতে তার বয়ান রেকর্ড করে তদন্তকারী দল। ওই কিশোরী পুলিশকে জানায়, আততায়ীর মুখ ঢাকা ছিল, তাই তাদের চিনতে পারেনি। এক তদন্তকারী অফিসারের মতে, ওই কিশোরীর বয়ানে অসঙ্গতি ধরা পড়ে। শেখানো বুলি আওড়ে যাওয়ার গন্ধ ছিল তাতে। তাই তদন্তের কাজে লাগতে পারে এমন কোনও জোরালো সূত্র হাতে আসেনি পুলিশের।

পরে ঘটনার তদন্তভার যায় গোয়েন্দা বিভাগ এসএসপিডির হাতে। গার্ডেনরিচ থানার অফিসারদের তরফে একাধিক বার পরিবারের সদস্য ও প্রতিবেশীদের বয়ান রেকর্ড থেকে শুরু করে, প্রত্যেকের কল রেকর্ড বিশ্লেষণ, সবই হয়। কিন্তু হাত ফাঁকাই থাকে তদন্তকারীদের। গোদের ওপর বিষফোঁড়া হয়ে ওঠে, পরিবারের সদস্যদের অসহযোগিতা। পরবর্তীকালে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকা হলেও হাজির হতেন না কোনও সদস্যই।

সব দিক খতিয়ে দেখে, সূত্রের অভাবে ২০১৮ সালে আদালতের আবেদনের মাধ্যমে কেস ফাইল ‘ক্লোজড’ করে দেয় পুলিশ।জোহরা খাতুনের খুনিরা আজও কোথাও মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নিচ্ছে ঠিক।