ক্রাইম ডাইরি

বাবা-মাকে খুনের পর ফুর্তি করতে বিদেশে উদয়ন

By admin

August 30, 2020

( দ্বিতীয় পর্ব)

কৌশিক সরকার

আকাঙ্ক্ষা খুনে অভিযুক্ত উদয়ন দাসকে নিয়ে পুলিশ সাকেতনগর থেকে ফিরলো গোবিন্দপুরা থানায়। বড় ব্রেক মিলেছে ভেবে তদন্তকারীরাও যেন অনেকটাই রিলাক্সড। কিন্তু আরও কিছু টুকটাক জানার চেষ্টায় চললো জেরা।বাকি তখনও আরও রহস্য।

যে রহস্য উদ্ঘাটন হয়ে যাওয়ার স্বস্তি ফিরছিল, উল্টে জেরার জবাব পেতেই মাথা ঘুরে গেলো সকলের। উদয়নের পরিবার, বাবা মায়ের সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে এলো বিস্ফোরক তথ্য। কয়েক বছর আগেই বাবা-মা কে চায়ের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে খুনের অভিযোগ স্বীকার করলো উদয়ন। কিন্তু কোনো তাপ উত্তাপ নেই। নিস্পৃহ গলা। কিন্তু সেটা কোথায়? কেন খুন? দেহ-ই বা কোথায়?এবার তো মধ্যপ্রদেশ পুলিশেরও আক্কেল গুরুম। কয়েক মাস আগে এই যুবকই তো স্ত্রী-র লেখা দাবি করে থানায় এসে চিঠি দিয়ে গিয়েছিল। বউয়ের বয়ানে নিজেই চিঠি বিয়ে, বাড়ির অমত, স্বামীকে বাবা-মা হেনস্থা করতে পারে বলে এই-ই তো থানাকে ঘোল খাইয়ে দিয়ে ছিল। ফলে এখন আবার বাবা-মাকে খুন করার খবরে মাথায় বাজ ভোপাল পুলিশের। তবে শেষ পর্যন্ত অবশ্য চাপ কমলো মধ্য প্রদেশ পুলিশের। কারণ এই রাজ্য ভাগের পর নতুন রাজ্য ছত্তিশগড়ের রাইপুরে গিয়ে সেখানকার বাড়িতেই খুন করে বৃদ্ধ দম্পতিকে ঘরের পাশে ফাঁকা জমিতে গর্ত খুঁড়িয়ে পুঁতে দেওয়ার কথা জানায় গুণধর সন্তান।

পরিবার

এ রাজ্যের হাওড়ায় আদি বাড়ি উদয়নের বাবার। এখনো সেখানে তার আত্মীয়রা রয়েছেন। যুবক বয়সে উদয়নের বাবা ভেল এ চাকরি সূত্রে ভোপাল যান। সেখানেই প্রবাসী বাঙালি পরিবারের মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হয়। তিনিও সরকারি চাকরি করতেন। কিন্তু রাজ্য ভাগ হওয়ার পর, উদয়নের মায়ের বদলি হয়ে রাইপুরে পোস্টিং হয়। ফলে ভোপালের বাড়ি একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে ভাড়া দিয়ে পরিবার রাইপুরে নতুন বাড়ি কিনে সেখানে চলে যায়। তার বাবা তার আগে ভেল এর চাকরি থেকে ইস্তফা দেন।একমাত্র সন্তান হওয়ায় একদিকে বাবা-মায়ের প্রবল চাপ ছিল ছেলেকে বড় কিছু করার ব্যাপারে। অথচ ছেলে ভালো পড়াশোনার বদলে অনেকটাই টেনেটুনে পাশ করার দলে। তার উপরে দেখতে কালো হওয়ায় ছোট থেকে স্কুলে বন্ধুরা পিছনে লাগতো। কালো বলে ছড়া কেটে চলতো টিপ্পনী। ফলে স্কুল-পড়াশোনায় অনীহা তৈরি হয় তখন থেকেই। তার উপরে ছিল মায়ের অত্যধিক চাপ। যা ছোট বয়স থেকেই ক্ষোভ তৈরি করে ছেলের ভিতরে।

কেন খুন?

কোনো রকমে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করলেও প্রায় জোর করেই মোটা টাকা ডোনেশন দিয়ে উদয়নকে বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি করে দেন বাবা-মা। কিন্তু ছেলে তখন একরকম উচ্ছনে যাওয়ার অবস্থা। প্রথম সেমিস্টারেই ফেল করে কলেজ যাওয়া বন্ধ করে দেয় ওই যুবক। কিন্তু বাড়িতে কিছু না জানিয়ে বছরের পর বছর কলেজের ফি সহ টাকা-পয়সা নিয়ে ওড়াতে থাকে নিজের মতো করে। এরইমধ্যে তার মা চাকরি থেকে অবসর নেন। আর ছেলে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়লেও কেন চাকরি পাচ্ছে না খোঁজ নিতে গিয়ে জানতে পারলেন ছেলের কীর্তি।ফলে ঘরে বসে থাকা বেকার ছেলের নিত্য ভাত ডালের সঙ্গে বাড়তি পাওনা হলো, চাকরি না পাওয়ার খোটা আর গঞ্জনা। দিনে নিয়মিত চা করা, বাসন মাজার মতো কাজ করতে হতো মায়ের চাপে। হাতে আর পয়সাও নেই। কত আর চেয়ে নেওয়া যায়! তাতে আরও বাড়ে খোটা। অথচ বাবা আর মায়ের যে ভালো টাকা-পয়সা আছে তা তো জানাই আছে ছেলের। অথচ তা নিজের খুশি মতো ভোগ করার উপায় নেই।বুড়ো-বুড়ি যদি না থাকে তাহলে সবই তো তার। তাহলে তাঁদের সরিয়ে দেওয়ায় নিজের ভালো থাকার এক মাত্র রাস্তা। যেমন ভাবা তেমন কাজ। রোজ বিকেলে চা করে তাঁদের সামনে দিতে হয়।২০১৫ সালে একদিন তেমনই চা করে সকলের অলক্ষ্যে তাতে ছেলে ঢেলে দিলো বেশি করে ঘুমের ওষুধ। আর তা খেয়েই ঢলে পড়লেন দুজনে চির ঘুমে। শেষ নয় সেখানে, মৃত্যু নিশ্চিত করতে এতদিন ইংরেজি থ্রিলার দেখা ছেলে প্লাস্টিক দিয়ে দুজনের মুখ বেঁধে দিলো।যেহেতু প্রতিবেশিদের সঙ্গে তেমন মেলামেশা ছিল না, আর একটা বাঙালি পরিবার নিজের মতো থাকে, তাই তেমন সখ্যতাও ছিল না পাড়া প্রতিবেশীদের সঙ্গে। ফলে কেউ খোঁজও তেমন করলো না। ঘরে মৃত দম্পতিকে রেখে ছেলে পরদিন মাটি খোঁড়ার লোক ডাকলো। বাড়ির পাশের ফাঁকা জায়গায় ট্যাংক তৈরি করবে জানিয়ে খোঁড়ালো গর্ত। রাতে সেই গর্তে বাবা-মায়ের দেহ ফেলে বালি আর মাটি দিয়ে তা চাপা দিয়ে আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে দিল সেই জায়গা।

ঠান্ডা মাথার খুন করে টাকা হাতিয়ে চললো ফুর্তি

এরমধ্যেই ধাপে ধাপে বাবা-মায়ের জাল ডেথ সার্টিফিকেট জোগাড় করে ফেললো। ফলে ব্যাংক থেকে টাকা পয়সা তোলায় বেগ পেতে হলে না তেমন।এবার নতুন মুক্ত জীবন। তার আগেই রাইপুরের সেই বাড়ি বিক্রি করে দিলো। ফিরে এলো ভোপালে নিজেদের পুরোনো বাড়িতে। উদয়ন তদন্তকারীদের কাছে বলে গেল সব কথা। হাতে তখন মুঠো মুঠো টাকা। বয়স পঁচিশের কোঠায়। ফলে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া যাওয়া, এসকর্ট সার্ভিসের মেয়েদের সঙ্গে ফুর্তির নতুন খেলায় মাতলো বাবা-খুন করা ছেলে। কিন্তু সেই মজাও বেশিদিন ভালো লাগলো না। আর পকেটেও হালকা হতে শুরু করেছে। ফলে একটা সঙ্গিনীর খোঁজ শুরু করলো। ফেসবুক খুঁজেই আরও অনেকের মতো টোপ দিলো দিল্লিতে পড়াশোনা করা বাঁকুড়ার ব্যাংক ম্যানেজারের মেয়ে আকাঙ্ক্ষাকে।

ফেসবুকেই স্বপ্নের জাল আকাঙ্ক্ষাকে

আকাঙ্ক্ষার নিজেকে জীবনে আরও উপরে নিয়ে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা দেখে ছক করে নিজেকে আমেরিকায় বড় চাকুরে হিসেবে পরিচয় দেয় উদয়ন। সেখানেই ভালো চাকরির ব্যবস্থা পাকা করে দেওয়ার টোপ দেয়। মিথ্যে কে সত্যি প্রমাণ করতে আমেরিকায় ইউনিসেফে চাকরির জাল নথিও দেখায় আকাঙ্ক্ষাকে। ফলে স্বপ্ন সত্যির হাতছানিতে মেয়ে তখন উদয়নের কাছে যেতে মরিয়া। বাড়িতে সব কিছু জানালেও অজানা আশঙ্কায় বাবা-মা নিষেধ করেন উদয়নের সঙ্গে যোগাযোগে। কিন্তু নাছোড় মেয়ে দিল্লি থেকে একবার বাড়ি ফিরে কিছু জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে পাড়ি দেয়। উদ্দেশ্যে আমেরিকা।কিন্তু দিল্লি থেকে তাঁদের যাওয়া কিছুটা পিছিয়েছে জানিয়ে উদয়ন আকাঙ্ক্ষাকে নিয়ে ‘কয়েকদিনের জন্য ভোপাল ঘুরে আসি’ বলে সেখানে যায়।

রূপ বদল

কিন্তু তারপর থেকেই উদয়নের আচার আচরণ বদলে যায়। এরইমধ্যে উদয়ন জানিয়েছিল তাঁর বাবা-মা দু’জনেই আমেরিকায় আছেন। কিন্তু একদিন ঘরেই আকাঙ্ক্ষা পেয়ে যায় তাঁদের পাসপোর্ট দুটি। এবার উদয়নের উপর চাপ বাড়ায় আকাঙ্ক্ষা। কিন্তু একসময় বিরক্ত হয়েই জানিয়ে দেয় বাবা-মাকে খুনের কথা।এবার নতুন ভয় পেয়ে বসে তাকে। আকাঙ্ক্ষা যদি ফাঁস করে দেয় সব কথা। ফলে পৃথিবী থেকে তাঁকেও সরানোর প্ল্যান করে উদয়ন। বাবা-মায়ের মতোই ঘরেই শ্বাসরোধ করে খুন করে লোহার ট্রাঙ্কে ভরে ঘরেই বেদী করে সেখানে চাপা দিয়ে দেয়।

তদন্তের সূত্রপাত–

বাঁকুড়ায় ব্যাংক ম্যানেজার ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে একদিন এলেন তৎকালীন পুলিশ সুপার সুখেন্দু হীরার অফিসে। দিল্লিতে পড়াশোনা করা মেয়ে এবং তারপরে উদয়নকে নিয়ে গত ঘটনা জানালেন পুলিশ সুপারকে। আরও জানালেন, মেয়ে এখন থেকে যাওয়ার পর আমেরিকায় পৌঁছেছে বলে জানিয়েছে মোবাইলে এসএমএস করে। কখনও জানায় অফিস থেকে এলাম, কোনো দিন জানায় সিনেমা দেখে ফিরলাম। কিন্তু কোনো দিন কথা বলে না। সবই করে এসএমএস করে। আবার উদয়নকে ফোন করে জানতে চাইলে, সে বলে মেয়ে এখনো অভিমান করে আছে বাবা-মায়ের উপর। রাগ কমলে কথা বলবে।গোটা ঘটনা শোনার পর দু’জনের মোবাইল ট্র্যাক শুরু করেন। প্রাথমিক ঘেটেই সাইবার সেলের ওসি সন্দীপ ব্যানার্জি প্রথম সূত্র দেন। আকাঙ্ক্ষার মোবাইলের টাওয়ার লোকেশন ভোপালে গিয়ে থেমে গেছে। সন্দেহ গাঢ় হয় এসপি-র। প্রথমে তবু ব্যাপারটা আরও নিশ্চিত হতে মেয়ের বাবা ও ভাইকে পাঠান ভোপাল। কিন্তু মেয়ে আমেরিকায় আছে আর উদয়ন আগেই স্ত্রী-র নামে চিঠি দিয়ে এসেছে গোবিন্দপুরা থানায়। ফলে কিছু না বুঝেই তাঁরা ফেরেন বাঁকুড়া। এবার পুলিশ মেয়েকে অপহরণ করার অভিযোগ নেয় পরিবারের থেকে। তখন বাঁকুড়ার আইসি রাজর্ষি দত্ত। জানুয়ারিতে তারপরেই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বের করা হয় উদয়নের বিরুদ্ধে।সেই পরোয়ানা নিয়েই টিম যায় ভোপাল। বাকি ঘটনা তো এখন জানা।

সূত্র দিলেন সেই-ই ইন্দ্রানী মুখার্জি

বর্তমানে কলকাতার ডিসি (আরএফ), বাঁকুড়ার তৎকালীন পুলিশ সুপার সুখেন্দু হীরা ঘটনা শোনার পর প্রাথমিক খটকা প্রসঙ্গে বলেন, মেয়ে মোবাইল থেকে এসএমএস করছে অথচ কখনো ফোন কেন করছে না, এটা ভাবতে ভাবতেই ভেসে ওঠে অন্য একটি ঘটনার কথা। তার কিছুদিন আগেই প্রকাশ হয়ে গিয়েছে ইন্দ্রানী মুখার্জি ও পিটার মুখার্জি-র কথা। নিজের মেয়ে সিনা বড়াকে খুন করে তাঁর ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিতেন মা। মেয়ের হয়ে মা-ই নানা ভালো ভালো মন্তব্য লিখতেন ফেসবুকে। পরে জানা গেলো আসল ঘটনা। সেই ভাবনা থেকেই কোথাও যেন নাড়া দিলো আকাঙ্ক্ষার মোবাইল থেকে এসএমএস রহস্যে।