এক নজরে

ভিখারিদের সাম্যবাদ

By admin

November 06, 2023

(গত সংখ্যার পর)

সাধনের গাওয়া আসরের শেষ গান সবারই মনকে কানায় কানায় ভরিয়ে দিল। রাধা কৃষ্ণের প্রেমসুধা উথলে উঠছে গোটা আসর জুড়ে। সমস্ত মানুষ আবেগ মথিত গলায় সাধনের সঙ্গে উদ্বাহু হয়ে সমস্বরে বলে উঠলো- নিতাই গৌর প্রেমানন্দে হরে হরে, হরিবোল! হরিবোল! হরিবোল! একবার বলো রে! মধুমাখা হরিনাম বলো রে!

দলের সবচেয়ে ছোট বালিকা, একটি স্টিলের রেকাবিতে প্যালা আদায় করছে ঘুরে ঘুরে। মেয়েদের দল আঁচলের খুঁট থেকে খুচরো সিকি, আধুলি, এক’টাকা, দু’টাকার কয়েন দিয়ে চলেছে নির্দ্বিধায়। বালিকাটিকে সামনে পেয়ে হাঁ হয়ে দেখছে সবাই। রঙবাহারি ঝলমলে শাড়ি, দু’পায়ে ঘুঙুর আর কপাল থেকে নাক পর্যন্ত রসকলি ও তিলক আঁকা। এর মধ্যে কয়েকজন আবদারের সঙ্গে বলে উঠলো কাল সকালে যেন তাদের বাড়ি যায়। মেয়েটি তো হতচকিত। ঘাড় নেড়ে সবাইকেই হ্যাঁ বলে চলেছে। মেয়েদের ভিড়ে একটুখানি থতমত হয়ে পড়েছে সে। পুরুষদের দিকে যেতেই পারেনি এখনও। ভাঙা আসর থেকে আস্তে আস্তে পাতলা হতে লাগলো।

সাধন ও তার বাউল দলের সদস্যরা সরঞ্জাম নিয়ে হাঁটা দিল জমিদার বাড়ির কাছারির দিকে। মন্দির চত্বরের বিপরীতে এই সুবিশাল কাছারি বাড়িতেই ডেরা বাঁধে সাধু বাউলের দল। ছোটবেলা থেকেই চেনা ছিল সাধনের। বাবা মায়ের সঙ্গে কত রাত কাটিয়েছে সে এখানে। বড় বড় গাইয়ে আসতেন তাদের দল নিয়ে। তখনকার দিনের বিখ্যাত কৃষ্ণকথার কন্ঠকবি, সাধক নীলকন্ঠ মুখোপাধ্যায়ের ছিল বাঁধা আসর। দোল কিম্বা রাস উৎসবের সময় তিনি ও তাঁর দল কাঁপিয়ে দিয়ে যেতেন গ্ৰাম বাঙলার ভক্তিরসের মাটি ও মানুষকে। পাশাপাশি থাকতো যাত্রা, নাটক, থিয়েটার, কবিগান ও কথকথার দল। বছরের বেশ কয়েকটি মাস জমে উঠতো জমিদার বাড়ির মঞ্চ থেকে নহবতখানা। কত ইতিহাস জমে আছে এই জমিদার বাড়ির চৌহদ্দি জুড়ে। সেই ইতিহাসের উত্থান পতন, মোগল-ইংরেজ বিরোধী লড়াই, স্বাধীনতা সংগ্রামের মৃত্যুঞ্জয়ীদের আশ্রয় এই জমিদার বাড়িকে ঘিরেই।

বঙ্গভঙ্গকে ঘিরে দেশ উত্তাল। বিলিতি বর্জনের সঙ্গে স্বদেশী আন্দোলন, স্বরাজের দাবিতে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে প্রত্যন্ত গ্ৰাম বাঙলা। এলো চরকা কাটার ধূম। ইংরেজদের গোলামখানা ছেড়ে একে একে গড়ে উঠতে শুরু করলো জাতীয় বিদ্যালয়। জমিদার বাড়ির কৃতবিদ্য উদ্যোগী ও বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ বাবু রাজশেখর চট্টোপাধ্যায় অবিভক্ত রঙপুর জেলার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের পদ ছেড়ে দিলেন স্বেচ্ছায়। দেশবন্ধুর ডাকে গড়ে তুললেন স্বরাজ্য পার্টি। তাঁর ডাকে একে একে এলেন দেশবন্ধু, বিপিন গাঙ্গুলি, নেতাজী সুভাষচন্দ্র সহ দেশবরেণ্য জাতীয় স্তরের নেতৃবৃন্দ। চারিদিকে সভা সমিতি, পিকেটিংয়ে মুখর হয়ে উঠলো গ্ৰামের পর গ্ৰাম। সবাই এগিয়ে এলেন সংগঠন গড়ার কাজে। কাছারি বাড়ির এক প্রান্তে শুরু হলো জাতীয় বিদ্যালয়ের পঠনপাঠন। অন্যপ্রান্তে গড়ে তোলা হল অভয় আশ্রম নামের চরকা কেন্দ্র। চারিদিকে হু হু করে ছড়িয়ে পড়লো এই চরম প্রস্তুতির খবর। ঢাকা, চট্টগ্রাম, বরিশাল, খুলনা, যশোর থেকে দলে দলে আসতে শুরু করলেন বাঙলার মুক্তিকামী দামাল দল। বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, বীরভূম, মেদিনীপুরকে ঘিরে সূচনা হলো এক মহাযজ্ঞের প্রস্তুতি।

সেই গৌরবময় ইতিহাস আর স্বদেশী আন্দোলনের সাক্ষী আজকের এই কাছারি বাড়ি। কুটকৌশলী ব্রিটিশ রাজস্ব অনাদায়ের ঠুনকো অভিযোগে জমিদারি নিলামে তুলতে চেয়েছিল। ব্রিটিশ কৌশলের জাল কেটে বেরিয়ে গিয়েছিল এ তল্লাটের অন্নদাতা চাটুজ্যে জমিদার বাড়ি। বিচক্ষণতা ও যুক্তি কৌশলের কাছে ধরাশায়ী হয়ে পড়ল ইংরেজ কুঠিয়াল। তবুও দেশের জন্য ও অসহায় দরিদ্র প্রজা সাধারণকে রক্ষা করার জন্য বহু ক্ষতি স্বীকার করতে হয়েছে তাদের। দীর্ঘ লড়াই সংগ্রামের সুফল এলো স্বাধীনতার মাধ্যমে। যাবার সময় বিষবৃক্ষ পুঁতে দিয়ে গেল ভারতভূমির বুকে। দেশমাতাকে এবং দুই ভাই কে নির্মম নিষ্ঠুর ভাবে ভাগ করে দিল বেনিয়ান দাড়ি পাল্লায়। দেশভাগ, শরণার্থী, আর বুভুক্ষু পর্বের মধ্যে কাল কাটানো শুরু হলো আমাদের। মধ্যস্বত্ত্ব লোপ, জমিদারি প্রথা বিলোপ, দেবত্র সম্পত্তি অধিগ্রহণ সহ বিষ জর্জর বাষ্প ছেয়ে ফেললো গোটা বাঙলাকে।

(চলবে)