এক নজরে

ভিখারিদের সাম্যবাদ

By admin

August 27, 2023

(গত সংখ্যার পর) 

এদিকে কাল্লার অভিনয় করা নিয়ে মা বাবার প্রায়শই  ঝগড়া বেধে যেত। অ’কথা- কু’কথা শুনতে হতো তাকেও। তাই একদিন কাল্লা নিজেই তিতি বিরক্ত হয়ে স্বেচ্ছায় দল ছেড়ে দেয়। আর ওমুখো হয়নি সে। এখন বাড়িতেই মালা কাটার কাজ করে।  মাঝে মাঝে বালিকা সঙ্গীতের কথা মনে পড়ে যায়। কত স্মৃতি, কত ইতিহাস তার বাবার নিজের হাতে গড়া বালিকা সঙ্গীতের দলকে ঘিরে।“পাহাড়তলী বালিকা সঙ্গীত  যাত্রা পার্টি” এই নামকরণও করে কাল্লার বাবা রসরাজ নিজে। নামের সঙ্গে যাত্রা পার্টি কথাটা জুড়ে থাকলেও মূলত তারা আখ্যানধর্মী পালা গানের আসর পরিবেশন করতো। বড়ুকবি চন্ডীদাস, ভক্ত কবি জয়দেব গোস্বামীর লেখা কাব্যনাট্য থেকে কীর্তনাঙ্গের ছোট ছোট পালা পরিবেশন করতো গাঁয়ে গাঁয়ে। মনসামঙ্গল থেকেও গীতিনাট্য তৈরি করতো রসরাজ। ছোট ছোট কিশোর কিশোরীকে গড়ে পিটে, তালিম দিয়ে দক্ষ করে তুলতো। কৃষ্ণ, রাধা-সহ কয়েকটি চরিত্রে একটু পরিনত বয়সের যুবক যুবতীকে দলে নেওয়া হয়েছিল। দল ছাড়ার আগে বেশ কয়েকটি আসরে নিজের মেয়ে কাল্লাবতীকে রাধা বা রাই কিশোরীর চরিত্রে অভিনয় করিয়েছে। কাল্লা ছেড়ে দেওয়ার পর ফেলু ময়রার মেয়ে শিবানীকে মনোনীত করে। কাল্লার মতো অতটা নিটোল অভিনয় না করলেও মোটামুটি কাজ চালিয়ে দিত সে। অভিজ্ঞতা বাড়লেই দক্ষতা আসবে বলে স্থির বিশ্বাস ছিল রসরাজের। প্রতিদিন আসরের আগে এক একটি পালা ধরে মহড়া হতো দলের সমস্ত কুশীলবদের নিয়ে। এতে দলের ভিত শক্ত হত বলেই তাদের ধারণা।

কোথাও কোথাও টানা আসর চলতো কয়েকদিন ধরে। গাঁ গঞ্জে সে কি উন্মাদনা! দলের লোকজনদের জন্য চাল, ডাল, শাকসবজি, মাছ, ডিম সংগ্রহ করে দিত গাঁয়ের উদ্যোক্তারা। দলের আস্তানা গড়ে উঠতো স্কুলঘর, লাইব্রেরী কিম্বা ক্লাব ঘরে। দলের মাইক, বক্স্ থেকে সুর পার্টি ছিল নিজেদেরই। এমনকি পেন্টার, মেকআপ ম্যান, ড্রেসার ছিল দলেই। তখন সবে ভিডিও হল, ভিডিও শো গ্ৰামে গ্ৰামে শুরু হয়েছে। তাই বালিকা সঙ্গীতের আসরকে জমজমাট করতে মূল পালার আগে আধঘন্টা নাচে গানে ভরপুর একটি বিশেষ প্রদর্শনীর আয়োজন করে রসরাজ। গাঁয়ের মানুষকে একটুখানি রিলিফ দেওয়ার জন্য ছিল- ড্যান্সারের বিশেষ নাচের দৃশ্য। আর এই স্পেশ্যাল নাচের জন্য দলে ঠাঁই পেয়েছিল “বিজলী সুন্দরী”। এই নামটির আড়ালে ঢাকা ছিল ছাতনা বাজারের যুবক গৌর ময়রার নাম। শুধুমাত্র দর্শকদের আকৃষ্ট করার জন্য এই মেয়েলী নামের চমক। তবে কতকটা মেয়েলী ঢঙ আর শারীরিক আদব কায়দাও নিখুঁত ছিল তার। হাঁটাচলা ও মাথার চুলেও ছিল জেল্লা। কোনও দিন খোঁপা করে আবার কোনও দিন বিনুনি করে চুল বাঁধতো গোরা। গায়ের রঙ ছিল একদম ফর্সা। তার দু’চোখে ছিল নাটক, থিয়েটার ও সিনেমায় অভিনয় করার রঙিন স্বপ্ন। তার জেরেই একদিন নিজের ঘর, পাঠশালা ছেড়েছিল তরুন যুবক এই গোরা ময়রা। স্কুলে পড়ার সময় বিখ্যাত বাঙলা সিনেমার শ্যুটিং দেখেছিল নিজের চোখে। বেশ কয়েকদিন এই সাদাকালো সিনেমার আউটডোর লোকেশন ছিল ছাতনা আর ঝাঁটিপাহাড়ি জুড়ে।ব্যস! লেখাপড়া আর আড্ডার তাল কেটে গেল গোরার। চোখের সামনে দেখছে নামজাদা অভিনেতা অভিনেত্রীদের। কি দরদ দিয়ে অভিনয়টা করে! সেই সব দেখে শুনে গোরার মনে তীব্র বাসনা জাগলো সিনেমায় অভিনয়ের। ক’দিনেই নেশা ধরে গেল রূপালী পর্দার মায়াবী জাদুতে। এদিকে তাকে ঘিরে জোর অশান্তি বাঁধলো ঘরে।বাড়ির লোকের চাপাচাপিতে শুধু জানালো কোলকাতার এক বিরাট নামডাকওয়ালা সাহেবের বাড়িতে কাজ পেয়েছে সে। ওখানে থেকেই কাজের সঙ্গে পড়াশোনা করতে পারবে গোরা। একদিন বাড়িতে এসে তার প্রয়োজনীয় পোশাক ও জিনিসপত্র টিনের বাক্সে ভরে নিল। বন্ধুবান্ধব, নিজের স্কুল ছেড়ে পড়াশোনায় ইতি টেনে সিনেমা দলের সঙ্গে রাতের ট্রেন ধরে পাড়ি দিল মায়া নগরী কোলকাতায়। অবিশ্বাস্য ভাবে কয়েকদিন পরেই একটা কাজ জুটে গেল তার। প্রতি মাসে কুড়ি টাকা বেতনে ফ্লোর বয় হিসেবে ঢুকলো গোরা। স্টুডিও পাড়াতেই তার কাজ। বিখ্যাত বাঙালি অভিনেতা কাম পরিচালকের বাড়িতে থাকা খাওয়ার সুযোগ পেয়ে গেল সে। আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল তার। বাংলার নামজাদা অভিনেতা ও পরিচালকের একমাত্র মেয়ে সুপর্ণা ম্যাম সাহেবের সঙ্গে প্রতি রবিবার যেতে হতো নাচের স্কুল, সুইমিংপুল-সহ মার্কেটিঙে। ম্যাম সাহেব খুবই স্নেহের চোখে দেখতো গোরাকে। এই ভাবে বেশ কয়েক বছর কেটে গেল কোলকাতার মাটিতে। ধীরে ধীরে গোরা নিজেকে গড়ে তুলছে তিল তিল করে। নিজেদের বাড়ির ছেলের মর্যাদা পেয়েছে সে। এরই মাঝে ছন্দ পতন ঘটলো আচমকা। একদিন সুপর্ণা ম্যাম চলে গেল মুম্বাইয়ে অভিনয়ের টানে। তার কিছুদিন পরই বড়বাবু হঠাৎ করে মারা গেলেন। গোরার একটা হিল্লে করে দিয়ে গেছেন বড়বাবু। থাকা খাওয়া ও পড়াশোনার কোনও সমস্যা না হয় তারও সুবন্দোবস্ত করে দিয়ে গেছেন। তবুও বেশ কিছুদিন পর এখানে মন টিকলো না গোরার। অগত্যা ফিরে এলো ছাতনার মাটিতে। ততদিনে অনেক পরিবর্তন ঘটে গেছে ছাতনার। বন্ধুবান্ধবদেরও অনেক বদল ঘটে গেছে অবিশ্বাস্য ভাবে। কেউ কেউ কাজ করতে চলে গেছে দামোদরের ওপারের খনি শিল্পাঞ্চলে। অনেক বন্ধু বিয়ে সাদি করে ঘোরতর সংসারি হয়ে গেছে। গোরা আজ বিশ্রাম নিয়ে বিকেলে যাবে দেবু ঠাকুরের দোকানে। পূজোর শীতল আর ফুলমালা কিনে মা বাসলীদেবীর মন্দিরে পূজা দেবে। সন্ধ্যায় আরতি দেখে পুরানো আড্ডাখানায় যাবে। সঙ্গে এনেছে কয়েকটি বিদেশি চুরুট আর পাইপ। ফতুয়ার পকেটে থাকা সেই বিদেশি তামাকের গন্ধে মঁ মঁ করছে।

(চলবে)