এক নজরে

ভিখারিদের সাম্যবাদ

By admin

February 03, 2024

সুকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়

(গত সংখ্যার পর)

প্রায় একঘন্টা অপেক্ষা করার পর  গোঙানির শব্দ ভেসে আসছে কাছ থেকেই। তাহলে কি গুলিতে জখম হয়েছে চিতাবাঘ? আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করাটা জরুরি বলে মতামত দিলেন শিকারে দক্ষ শশিশেখর। এরিকসন সাহেবও একই মতামত দিলেন। দলের অন্য আর এক সদস্য শম্ভু সর্দার শিকারি জাল নিয়ে ওত্ পেতে রইল শুঁড়ি পথের মুখে। ডান হাতে শক্ত করে ধরা আছে তীক্ষ্ণ বল্লম। এরিকসন সাহেব মাচা থেকে নেমে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে আসতেই ভয়ঙ্কর গর্জন শুনতে পেলেন। একসঙ্গে তাক করে গুলি ছুঁড়তেই কিছুক্ষণ পর নিস্তেজ হয়ে পড়লো। হরিণ দলের কোনও সাড়াশব্দ নেই। ইশারায় শম্ভুকে ডাকলেন। জাল কাঁধে বল্লম হাতে সন্তর্পনে পা ফেলে এগোচ্ছে শম্ভু। একশো শতাংশ নিশ্চিত হয়েই এগিয়ে চলেছে শম্ভু।এর আগে বন শুয়োরের মুখোমুখি হয়েছিল সে। প্রাণ হাতে নিয়ে কোনোও রকমে পালানোর সুযোগ হয়েছিল তার। সবচেয়ে বিপজ্জনক হয়ে ওঠে জুন – জুলাই মাস। তখন জঙ্গলে ঢোকা একেবারে নিষিদ্ধ হয়ে পড়ে  শুধুমাত্র নিরাপত্তার জন্য। ওই দু’মাস সমস্ত স্তরের জীবজন্তু, পশুপাখির প্রজননের সময়। তারা দুর্ভেদ্য দুর্গ বানিয়ে রাখে এই গহীন বনাঞ্চলকে।

শিকারের উপযুক্ত সময় হল বসন্ত ঋতু। তখন আবার গোটা বন জুড়ে ভালুকের তান্ডব শুরু হয়ে যায়। মহুয়া ফুল খেতে আসে তারা দল বেঁধে। ইদানীং বন দফতরের আধিকারিক ও সমস্ত স্তরের কর্মীদের উদ্যোগে শুমারি চলে। তাদের রিপোর্টে স্পষ্ট উল্লেখ আছে, ভালুক সহ হায়েনা, নেকড়ে, শজারু এমনকি শেয়ালের সংখ্যা বেড়েছে কয়েকগুণ। হাতিদেরও যাতায়াত বেড়ে গেছে অস্বাভাবিক হারে। বেশ কয়েকটি হাতি আবার “রেসিডেন্সি ” স্ট্যাটাস পেয়েছে বন দফতর থেকে। বাঁকুড়ার বনাঞ্চল তাদের কাছে পরম নিরাপদ আবাস হয়ে উঠেছে যুগ যুগ ধরে। রামায়ণের শ্রেষ্ঠ রাজা রঘুর  দিগ্বিজয় অভিযানের সময়কাল থেকেই বুনো হাতির অবস্থানের কথা জানা যায়। তাদের দাপট গোটা ছোটনাগপুর মালভূমি অঞ্চল জুড়ে।

ক্রমশ অন্ধকার নেমে আসছে গোটা বন পাহাড়ে। নির্জন বন আবার আগের মতোই শান্ত সমাহিত চরিত্রে ফিরে গেছে। শম্ভু মৃত চিতাবাঘকে জালে জড়িয়ে মাচার কাছে আনলো। সবাই মিলে উৎফুল্ল হয়ে এরিকসন সাহেবের গাড়িতে উঠে পড়লেন।

জমিদার বাড়ির মূল ফটকে এসে গাড়ি থামতেই হঠাৎ উৎসবের মেজাজে ঢাকা পড়ে গেল জমিদার বাড়ি। গোটা গ্ৰামজুড়ে শুরু হয়ে গেল উল্লাস আর শিকার করে আনা চিতা দেখার ধূম। বাঘ শিকারের খবর চাউর হতেই চাটুজ্যে বাড়ির দেউড়িতেও কাছারি বাড়ির ফটকে মেলার মতো ভিড় জমে গেল আচমকাই।শশিশেখর বন্দুক, টোটা সহ অন্যান্য সামগ্রী তুলে রাখলেন তাঁদের স্ট্রং রুমে। শম্ভুর দায়িত্ব চিতার চামড়া খুলে হাড় মাংস ভাগাড়ে পাঠিয়ে দেওয়া। চামড়াটির সংরক্ষণের জন্য কয়েকটি ধাপ যত্ন নিতে হয়। কিছুদিন পর সেই চামড়া শোভা বর্ধন করবে অতিথি নিবাসের দেওয়ালে। এই রকম ভাবে কয়েকটি প্রজন্মের শিকার লব্ধ পশু পাখির চামড়া, স্কেলিটন সংরক্ষিত রয়েছে। শুধু আভিজাত্যের প্রকাশ নয়, এর মধ্যে লুকিয়ে আছে তাদের শৌর্য বীর্যের ইতিহাস। প্রতি বছর শিকারে যাওয়ার রীতি রেওয়াজ রয়েছে বংশ পরম্পরায়। সেই সব বর্ণময় অতীত ইতিহাস আজও জ্বলজ্বল করছে স্বমহিমায়।

কাছারি বাড়ির উঠোনে পরাণ জেলে খালুইয়ের মাছগুলোকে ঢেলে রাখলো। সঙ্গে সঙ্গে চলে এলো এক পরিচারিকা। শশিশেখর চলে গেলেন অন্দরে। পরাণ জাল কাঁধে নিয়ে চলে গেল বাড়ির পথে।

চলবে