এক নজরে

ভিখারিদের সাম্যবাদ

By admin

November 14, 2023

(গত সংখ্যার পর)

তারপর কেটে গেছে বহুকাল। আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে জাতীয় স্মারক হয়ে এই গৌরবময় কাছারি বাড়ি। আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে বর্ণময় ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে।অতিথি অভ্যাগতদের ঠাঁই মেলে সাদরে। বাৎসরিক উৎসব অনুষ্ঠানের পাশাপাশি বহু পর্যটক, ছাত্রছাত্রী, গবেষক সহ নানা স্তরের আগ্রহী মানুষ আসেন ঘুরতে।

সেই সব উৎসব অনুষ্ঠানকে বাদ দিয়েও সারাবছর দু’ পাঁচ’জন মানুষ ঠাঁই পান অতিথিশালায়। বিরাট উঁচু পাঁচিল দেওয়া বাগান, পুকুর আর সারি সারি অতিথি নিবাস গোটা কাছারিবাড়ি জুড়ে। কূয়ো, ইঁদারা ছাড়াও রয়েছে নলকূপ। রয়েছে বেশ কয়েকটি শৌচাগার। চুন সুরকি দিয়ে ইঁট বাঁধানো পুকুর ঘাট। মেয়েদের ঘাটটি বেশ বড় ও চারিদিক পাঁচিল ঘেরা। পোশাক পাল্টানোর আলাদা ঘরও রয়েছে একটি। সাবেক আমলের দেওয়াল, মেঝে ও ঘরগুলোতে পলেস্তারা ছাড়িয়ে সিমেন্ট দিয়ে সংস্কার করা হয়েছে। দু’শো, আড়াইশো বছর আগের টিন ও টালির ছাউনি খুলে দিয়ে অত্যাধুনিক নির্মাণ প্রযুক্তির সাহায্যে ছাদ ঢালাই থেকে মার্বেল, টাইলস আর ব্লক বসিয়ে আপাদমস্তক ভোল পাল্টানো হয়েছে গোটা কাছারি বাড়ির চৌহদ্দি। আমূল সংস্কারের সময় নিজেদের মধ্যে একটুখানি মতপার্থক্য দেখা দিয়েছিল দু’ তিনটে  বিষয় নিয়ে। বাড়ির আধুনিক মনস্ক সদস্যের কেউ কেউ বলেছিলেন পড়ে থাকা ঘোড়াশাল, নহবতখানা ও রঙমহল ভেঙে ফেলতে। প্রাচীন পন্থীদের দাবি, এইগুলো তাদের পারিবারিক ঐতিহ্য ও পরম্পরা। আগে ঘোড়াশালে তাদের পছন্দ মাফিক ঘোড়া থাকতো। বড় ও ছোট তরফের দুই কর্তা বাবুর ছিল আরবি ঘোড়া। আরও একটি নবাবী ঘোড়া আনা হয়েছিল দিল্লি থেকে। তখনকার নবাব, বাদশাহদের অতি প্রিয় ছিল এই ঘোড়া। জমিদার পরিবারের সঙ্গে মোগল সুবেদারের ছিল সখ্যতা।  

রাজস্বের কাজে মাঝে মাঝে সুবে বাঙলার এ দিকটায় এলে উঠতেন জমিদার বাড়ির অতিথি নিবাসে। ঘোড়া, পালকি কিম্বা নিদেনপক্ষে গরুর গাড়ি বরাদ্দ করতে হতো সুবেদারের জন্য। মুর্শিদাবাদ থেকে স্থায়ী ভাবে এখানে আনা হয়েছিল মোগলাই খানা বানানোর সুদক্ষ রসুইকার। একবার শীতকালে এই রঙমহলে বসেছিল নাচগানের আসর। লক্ষ্ণৌ থেকে আনা হয়েছিল আতরবাঈ নামের এক বছর আঠারোর নৃত্য পটিয়সী। সঙ্গে এসেছিল এসরাজ ও সানাই বাদক ফকির সাহেব। পুরো নাম- ওস্তাদ ফকরুদ্দিন খাঁন। একমাস ধরে চলেছিল ধ্রুপদ ঘরানার ঠুংরি, গজল আর খেয়াল। সঙ্গীত প্রেমী ও ধ্রুপদ ঘরানার পৃষ্ঠপোষক। গানের মজলিস বসতো বিভিন্ন সময়ে। আবার রাস ও দোল উৎসবে মেতে উঠতো আপামর গ্ৰামবাসী থেকে আত্মীয় স্বজন। ধর্মীয় হোক আর নিছক বিনোদনের জন্য অঢেল খরচ আসতো জমিদার বাড়ির খাজাঞ্চিখানা থেকে।

তখন ছিল কাঁচা টাকা রোজগারের রমরমা। কয়লাখনি থেকে ওড়িশার আকরিক খনিজের  মালিকানা ও এজেন্সি ছিল এ বাড়ির কর্তাদের । আসাম, দার্জিলিং ও ডুয়ার্সে ছিল খাস মালিকানাধীন চা-বাগান। এতসব ব্যবসা বাণিজ্য অটুট রাখার জন্য পদস্থ আধিকারিক থেকে বহু সাহেব সুবোদের ছিল প্রাত্যহিক আনাগোনা। সেদিনের মতো কাছারি বাড়ি হয়তো জৌলুস হারিয়েছে তবুও ম্লান করে দেয়নি জমিদার বাড়ির বর্তমান প্রজন্ম। তারা শুধু নতুন প্রযুক্তিতে নতুন করে গড়তে চায়। আবার প্রাচীনপন্থীরা হেরিটেজ হিসেবে ধরে রাখতে চায় এই অংশটিকে। তাছাড়া বহু ব্যয়ে ও শ্রমসাধ্য নির্মাণশৈলীকে সংরক্ষণ করে রাখাই মূল উদ্দেশ্য।

কেয়ারি করা বাগান ও ফোয়ারা বসিয়ে নিত্যদিনের অবসাদ,ক্লান্তি দূর করতে আসেন এই বাড়ির নবীন প্রবীণদল। সমান উৎসাহ নিয়ে খেলাধুলা করে কচিকাঁচার দল। পাশাপাশি বসবাস করা জ্ঞাতিগোষ্ঠীর লোকজনও আসেন সময় কাটাতে। কুলদেবতার তিনবেলা পূজা আরাধনা হয়ে আসছে পুরুষানুক্রমে। শ্রীশ্রীরঘুনাথজীউ আর রাধামাধবের জন্য সেবাইত হিসেবে স্থানীয় গোস্বামী পরিবার নিয়োজিত। কালী, দুর্গা,শিব সহ অন্যান্য বারোমাসের পূজাপাঠ, ভোগ সেবার কাজ গ্ৰামেরই বাসিন্দা ভট্টাচার্য ও বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবার করে আসছে বহুকাল ধরে। তার জন্য দেবোত্তর হিসেবে জমি জায়গা‌, পুকুরের অংশ দেওয়া হয়েছিল সাজা বন্দোবস্ত হিসেবে। এছাড়াও এই পুরোহিত পরিবারের ছেলে মেয়েরা পড়াশোনা থেকে চাকরি বাকরি তে ও প্রভূত সাহায্য সহযোগিতা পায়। চাটুজ্যে বাড়ির কাজে নিয়োজিত বহু মানুষ বিভিন্ন ভাবে সাহায্য পেয়ে আসছে। দিন বদলের ডাকে এই পরিবারের একজনও সামিল হননি বর্তমান রাজনীতিতে। বরং তারা রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা নেত্রীদের “মেন্টর” হিসেবে কাজ করেন।