এক নজরে

ফিরে আয়, ফিরে আয়

By admin

March 28, 2024

পক্ষকাল আয়ু। মেরে কেটে ২২ দিন। তার নেশা লাগতে লাগতে, চিনে নিতে নিতে ধা করে উধাও। যৌবনের উন্মাদনার মতো ক্ষণস্থায়ী। তবে যৌবনের মতোই এই ক্ষণস্থায়ী সুখ চলে গেলেও স্মৃতি থেকে যায় পুরো বছর। কোনও কোনও সময় হয়তো সারা জীবন। কুঁড়িগুলো দেখতে অনেকটা বাঘের নখের মতো। ভয়ঙ্কর। আঁকাবাঁকা ডাল যখন পাতাশূন‌্য হয়, তখনই থোকায় থোকায় নীল দিগন্তে আগুন ছড়ায়। ফুল ফোটার সময় গাছ থাকে পাতাশূন্য। দূর থেকে দেখে মনে হয় গাছে যেন আগুন লেগেছে। মুষড়ে পড়া জীবনে আগুনরঙ দেখতে কে না পছন্দ করে। আর সেই আগুনে ঝাঁপ দিতে আমার মতো কতশত হৃদয় যে দিনরাত্রি লাফায় তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু বিশ্বাস করতে পারো পলাশের রঙ লাগা সেই ভালোবাসার নাম আমি রাখতে পারিনি কোনও দিন।

অন্নপ্রাশনে দেওয়া নাম বদলে নিজের মতো করে নাম রাখার একটা বুকের পাটা থাকতে হয়। তা সে বিচ্ছুই হোক বা অন‌্যকিছু। আসলে এটাও ঠিক, নাম রাখতে গেলে তো তাকে বুঝতে হয় অনেক গভীরে। দেখতে হয় তার চলন,  মাখতে হয় তার আবছায়ার মধ্যে লুকিয়ে থাকা আলো। কঠোর প্রবন্ধের মধ্যে খুঁজে পেতে হয় অন্তঃসলিলা কবিতার ছন্দ। সেই উপলব্ধি লব্ধ হওয়ার সময় কোনওদিনই পলাশ দেয় না। কারণ তার আয়ু তো মাত্র ওই কটাদিন। বসন্তের আয়ুও তাই। মেরেকেটে পক্ষকাল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই দিব্যি পালিয়ে যেত। খুব বেশিদিন এক জায়গায় তার থাকার অভ‌্যাস তার ছিল না, আজও নেই। কেবল এইটুকু বুঝি, সে এলে সব কিছু ওলটপালট হয়ে যেতে পারে এক লহমায়।

মেঘভাঙা বৃষ্টি যেমন কিছু বোঝার আগেই ভাসিয়ে এলোমেলো করে দিয়েছিল সিকিম, উত্তরবঙ্গকে। বাঁচার শেষ মুহূর্তটাও বুঝে উঠতে পারেননি সেখানকার হাজার হাজার মানুষ। ঠিক তেমনই পলক ফেলবার আগেই পলাশ আমাকে নিয়ে চলে যেতে পারে হারিয়ে যেতে বসা সম্পর্কের সামনে আর টিমটিম করে জ্বলে থাকা আশার আলোর পাশে। অথচ যে সব রাস্তা আমি এড়িয়ে চলেছি বসন্ত বাদে সারাটা বছর। ভেসে যাবার মুহূর্তটায় আর কিছু করার থাকে না ঠিকই, কিন্তু এও ঠিক, শীত শেষে আশ্চর্য সেই হাতের অপেক্ষা শুরু হয়ে যায় ভেতর ভেতর। সেটাও তো এক শীত শেষে এগিয়ে এসেছিল গাছতলায়। আমার কানে কানে দিয়েছিল দুঃসাহসের ফুস মন্তর। বলেছিল, দেখে নেব সবটা। লালমাটি বলব না। কাঁকুরে মাটির গ্রামে আমার বাড়ি। বাড়ির খানিক আগে একটা বড় পুকুর। তার পাড়ে আমবাগান। রাস্তার ধারে একা দাঁড়িয়ে থাকত একটা পলাশ গাছ। সেও অনেক বছর আগের কথা।

এখন সেই গাছটাকে খুঁজি। নেই। তখন কিন্তু গ্রামগঞ্জে বেশ পলাশ ফুটত। ক্রমশ চড়া হওয়া রোদে যেন তার জেল্লা আরও খুলে যেত। সদ‌্য প্রেমে পড়া স্কুলছাত্র পলাশের সেই রঙে খুঁজে নিত প্রেমের আস্বাদ। মনে হত, ঠোঁটে আগুন না নিতে পারলে প্রেমিকজন্ম বৃথা যে! তখন গ্রামে নিয়ম করে গাজন হত চৈত্র শেষে। গাজনের শেষদিনে ভক্তারা আগুনের উপর দিয়ে হেঁটে যেত। বড় লোভ হত। আগুনকে হারিয়ে গটগট করে সেই হেঁটে যাওয়ার দৃশ‌্য বড্ড লোভনীয় ছিল অনেকের মতো আমার কাছেও। কাজল কালো এক প্রেমিকাও ছিল সেই বয়সেই। মুখে ছিল শ্রাবস্তীর কারুকার্য। একদিন তাকেও বললাম, চলো আগুনের উপর দিয়ে হাঁটি। বুঝতে পারল না। মনে আছে হাত ধরে নিয়ে গিয়েছিলাম খানিক দূরের এক পলাশ বাগানে।

রাস্তায় পলাশ পড়ে থাকত অগুনতি। দূর থেকে দেখে মনে হত রাস্তায় কেউ আগুন ঢেলে দিয়েছে। বসন্ত শেষে দমকা হাওয়ার মতো সেই কৃষ্ণকলি প্রেম হাওয়া অন‌্য কোথাও, অন‌্য কোনওখানে। আর আমি পলাশের বিলাসিতা কুড়িয়ে নেওয়ার অভ‌্যাস শুরু করলাম। সেই আছিলায় বসন্তের সঙ্গে তো আরও কয়েকটি বছর গা ঘেঁসে থাকা যাবে। বয়স বেড়েছে অনেকটা। জীবন যৌবনে গোধুলী ছাড়িয়ে সন্ধা নামছে। পাখিয়া ফিরে যাচ্ছে নিশ্চিন্ত নীড়ে। পলাশ হাওয়া আমাকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে এমন একটা জায়গায় যেখানে নিস্তব্ধ পাহাড় ঠাঁয় দাঁড়িয়ে অনন্তকাল। তাকে আশ্রয় করে বাঁচা যায়, জড়িয়ে ধরার ব‌্যাপ্তী নেই এই বাহুবলে। সেই বৃহৎ পাহাড়ের সামনে দাঁড়িয়ে কেবল গরল তরলে ঠোঁট সিক্ত করা ছাড়া আর উপায়ই বা কী! 

প্রেমিক এখানে শিল্প। আর শিল্পীকে দিতে হবে সংযমের পরীক্ষা। এদিক ওদিক বেচাল হলেই ফিরে আয় ফিরে আয় বলে ডাকবে ফেলে আসা দিনগুলি। ‘ফাগুন করিছে হা হা ফুলের বনে’… আমি তো হেঁটেছি সেই পলাশ ফুলের বনে, অস্থির হয়ে ওঠা অপারগ ফাগুনকেও তো দেখেছি একেবারে কাছ থেকে পরতে পরতে। আদরে জড়িয়ে, ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিয়ে। মনে করার চেষ্টা করলাম রবীন্দ্রনাথেক আগের লাইনটি।  ‘বিধুর বিকল হয়ে খ্যাপা পবনে’। বিধুর আর বিকল-কে পাশাপাশি বসাতে গেলে একজন মানুষকে রবীন্দ্রনাথ হতে হয়। আর ফাল্গুনের পবন?  চিনচিন বুকের বাঁদিকে এসে ধাক্কা মারে সেই বিচ্ছু মুখটি।