এক নজরে

আবার আসিব ফিরে

By admin

March 03, 2024

আশ্চর্য সুন্দর সূর্যাস্ত, স্ফটিক স্বচ্ছ নীল জল আর সাদা বালির এশিয়ার অন্যতম সেরা সমুদ্র সৈকত- এইসব একসঙ্গে এ দেশের মাটিতে যেখানে রয়েছে, তার নাম আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ।এখানে আমি জন্মেছিলাম। এবার পেশা সূত্রে সেখানে যাওয়ার সুযোগ ঘটে গেল। এর জন্য আমি যেখানে চাকরি করি সেই সংস্থার কাছে কৃতজ্ঞ।

গ্রীষ্ম কিংবা শীত, যে কোনও সময়ই পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় ও স্বপ্নের গন্তব্যস্থল হল আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ। ৫০০টিরও বেশি দ্বীপ নিয়ে গঠিত এই দ্বীপপুঞ্জ অবিশ্বাস্য ও বিস্ময়কর বিচ রয়েছে। তবে শান্ত আর সবুজের এই দেশে প্রথম যেটা নজর কাড়ে তা এখানকার মানুষের ব্যবহার। আমার দু বছরে তিনবারের যাত্রাতে আমি কখনো কাউকে উঁচু স্বরে কথা বলতে শুনিনি, ঝগড়া তো দূর অস্ত। সুন্দর উঁচুনিচু পথঘাট, কেউ কাউকে অতিক্রম করে চলছে বা গতি নিয়ন্ত্রণ বিধি লঙ্ঘন করছে এমনটাও দেখিনি। অদ্ভুদ ভালোলাগার একটা শহর পোর্টব্লেয়ার, যে তার নিজের গতি, ঐতিহ্য আর পর্যটন নিয়ে এগিয়ে চলেছে।

আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ ভীষণই খরচ সাপেক্ষ কারণ, পর্যটনই এখানে আয়ের একমাত্র উৎস তেমনি এখানে মানুষের গড় আয়ও অনেক বেশি। যেমন একটি নামি সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একজন উচ্চ পদস্থ শিক্ষকের মাসিক বেতন ৭৫-৮০ হাজার টাকা। যেহেতু জীবনযাত্রা খুবই সীমিত চাহিদার মধ্যে তাই মানুষের সঞ্চয়ও যথেষ্ট বেশি। এখানকার মানুষ খুবই অতিথি বৎসল, সাহায্যের হাত বাড়াতেও তারা সব সময় প্রস্তুত।  

আমার নিজের কাজের ফাঁকে দ্বিতীয় দিন আমার জন্মস্থানে যাওয়ার সুযোগ পাওয়াতে আর দেরি না করে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম। স্থানীয় দক্ষিণী গাড়িচালক শিবা নানা রকম গল্প করতে করতে যাচ্ছিল। আমার নিজের সম্পর্কে বলতেই আর ৪৫ বছর বাদের ফিরে আসার কথা শুনে ওঁ তার দারুণ বর্ণনা করলো। ওঁর মতে এটা কাকতলীয় নয় আমি নাকি আসতামই, এটাই নাকি সরল সাধাসিধে মানুষদের ধারণা। আসলে বিশাল বঙ্গোপসাগরের মধ্যে এই দ্বীপের লোকেরা আমাদের তথাকথিত দ্রুতগতির সভ্যতার অনুকরণ না করে নিজেদের ধ্যান ধারণা নিয়েই থাকে।

উইমবার্লিগঞ্জ যাওয়ার পথে সবুজের সমারোহ এতই মন্ত্রমুগ্ধকর যে গ্রীষ্মের দাবদাহ আমাকে কোনোমতেই স্পর্শ করতে পারেনি বরং মৃদু শীতল অনুভূতি এনে দিয়েছিল। শিবা অনাহুত ভয়ঙ্কর সুনামির আছড়ে পড়ার বর্ণনা দিচ্ছিল আর তার কিছু প্রতিফলন দেখাচ্ছিল যেটা আজও এই দ্বীপপুঞ্জের মানুষদের আতঙ্কিত করে রেখেছে। সবুজের পথ বেয়ে অবশেষে আমি আমার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় জায়গার দোরগোড়ায় উপস্থিত হলাম। স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম আমার বুকের ওঠানামা, চামড়ার রোমের দাঁড়িয়ে যাওয়া যেন বহুযুগ ধরে অপেক্ষমান আমার প্রেমিকার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি। জমিটা কি ওই রকমই আছে না কোনো সরকারি বাসস্থানে পরিণত হয়েছে? নাঃ একই আছে, কারণ আমার কাঠের বাড়ি না থাকুক অন্তত জমিটা দেখে প্রত্যেকটা অংশ আমি এঁকে দেখাতে পারি। ওই পিলারের কাঠের গেট, মার লিলি গাছ আর গাঁদা ফুলের গাছ, বাদিকে বেশ কিছু কলাগছের সারি, ডানদিকে কিছু বেগুন, টমেটো, ধনেপাতার গাছও লাগিয়ে ছিল। পেছনে আমাদের পাচক কৃষ্ণণের ঘর ছিল। নাচেপান্না যে আমায় তাম্বি নামটা দিয়েছিল সে সকালে আসতো আর রাতে বাড়ি ফিরে যেতো।

বেশ কিছুক্ষণ বাবার সকালের অফিসে দাঁড়ালাম সেখান থেকে দরজা দিয়ে লিভিং রুম-এ পৌঁছলাম। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি বাবা, মা, নিতু কাকা, ঝর্ণা কাকিমা, রাও সাহেব রামি খেলছে। ওই ঘর থেকে বেরিয়ে লম্বা ভেতরের বারান্দায় যেতেই অনুভব করলাম, আমি লম্বা হয়ে গেছি তো। একটা নিকবরী কলার কাঁদি ঝুলতো লাল রঙ খোসাটার। বাদিকে তাকিয়ে রান্নাঘরটার চিমনির ধোঁয়া গলগল করে পেছনের পাহাড়টার দিকে চলে যাচ্ছে। বারান্দা দিয়ে ডানদিকে প্রথম বেডরুমটায় ঢুকলাম, মার চোখ গোল করে বকাটা মনে পড়লো, মা ঘুমোতে বলতো আর আমি ঘুমাবো না। হাসতে হাসতে বেরিয়ে ঠাকুরঘর কাম স্টোররুমটায় ঢুকেই বেরিয়ে এলাম কারণ, ওটা আমার ভালো লাগতো না। আবার ভিতরের বারান্দায় এসে তিনটে সিঁড়ি বেয়ে উঠোনে নামলাম, মার গলার আওয়াজ বঙ্গারামকে, বড়ো বড়ো ড্রামে জল ভর্তি করতো আর রোজ দেরি করতো বলে মার বকুনি খেত। ছাগলটা কে যে কি কষ্ট দিত নাচেপান্না কারণ, মা আমাকে ছাগলের দুধ খাওয়াবেই আর আড়চোখে চৌকো সিং মাছের চৌবাচ্চার দিকে কটমট করে তাকাতেই মনে পড়লো ছোটবেলার এই অপছন্দের জিনিশগুলো আজ কি ভালোই না লাগছে।

পিছনের উঠোন দিয়ে রান্নাঘরকে বাদিকে রেখে কৃষ্ণণের ঘরকে ডান দিকে রেখে কলতলার পাশ দিয়ে আবার বাড়ির সামনে এসে পৌঁছলাম। ওমা দেখি পন্ডিতজী উপস্থিত। না কোনো পুজোর ব্যাপার না। বাবার উইলিস জীপের ড্রাইভার পন্ডিতজী। খাকি হাফ প্যান্ট, খাকি কেটস, সাদা শার্ট, সাদা চুল বাবাকে নিয়ে বেরোবে বলে। আমাকে দেখেই গাড়ির ঝুলন্ত চাবিটা দৌড়ে গিয়ে হাতে নিয়ে নিল। কারণ একবার আমি টুক করে উঠে চাবি ঘুরিয়ে জীপ স্টার্ট করে দিয়েছিলাম। হাসতে হাসতে ওনাকে বিদায় জানিয়ে আমার ভাড়ার জাইলোটাতে উঠলাম ফেরার জন্য। বাবাকে দেখলাম জীপের ডানদিকে একটা পা বের করে বসে উপরের হাতলটা ধরে বসে সামনে সটান তাকিয়ে দিঘলিপুর সাইটের এর দিকে বেরিয়ে গেলেন। শিবার আচম্বিত ডাক, স্যার ওয়াপাস যানা হায়, ঘোর কেটে গেলো, প্রায় আধ ঘন্টা ভালোই কাটলো স্মৃতির স্বরণী বেয়ে, এবার ফেরার পালা। শুনলাম CPWD ওখানে স্টাফ কোয়ার্টার বানাবে। ভালো! বাসস্থান সবারই দরকার। পোর্টব্লেয়ারে কাজ সেরে রাতে একটা বার-এ আমি আর দীপঙ্কর দু পেগ করে হুইস্কি আর একটু কাবাব খেয়ে দীপঙ্কর ওর বাড়ির পথে আর আমি হোটেল।

এখন ফ্লাইটে কলকাতা ফিরছি, বাস্তবে ফিরে আয় তাম্বি, অনির্বান জিজ্ঞেস করবে, অরবিন্দ দা হোস্টেল এবার ২০০ হবে তো? গিয়েই তুন্নার ডাক্তার দেখানো, তারপর শালার আজ হসপিটাল থেকে ছাড়া পাওয়া, অনেক কাজ। বাবা আর মা কোয়ার্টারের সামনে ছোট্ট সবুজ ঘাসের ওপর চেয়ার পেতে বসে বিকেলে চা খেত। জীপ থেকে নেমেই বাবা ওখানেই বসত, চা খেয়ে তারপর ফ্রেশ হতে যেত। দেখি আমার দিকে তাকিয়ে দুজনেই হাসছে “কেমন লাগছে তাম্বি, এটা আমরাও করে এসেছি এতদিন, এবার তুই কর” আস্তে আস্তে সব মিলিয়ে যেতেই পাইলটের স্বর, “fasten your seat belt”. কল্লোলিনী কলকাতায় পৌঁছলাম।