কলম্বাসের এই ইতিহাসের তলায় চাপা আছে অসংখ্য নিরপরাধ মানুষের আর্তনাদ। দাসে পরিণত হওয়া অসহায় মানুষের যন্ত্রণা। কারণ, কলম্বাস খুনী ও অত্যাচারী শাসক হিসেবে দুটি ঐতিহাসিক ঘটনা সংঘটিত করেছিলেন।এক; দাস বাণিজ্য ও আমেরিকায় আদিবাসী ইন্ডিয়ানদের গণহত্যা। তাছাড়া কলম্বাস আমেরিকা মহাদেশে পা রাখা প্রথম ইউরোপিয়ান নন। তথ্য অনুযায়ী, তারও ৫০০ বছর আগে লেইফ এরিকসন নামের আইসল্যান্ডের একজন পরিব্রাজক উত্তর আমেরিকায় পা রাখেন।
লোভী কলম্বাস টাকা ও সুনাম কামানোর জন্য ছিলেন উদগ্রীব। স্পেনের রাজা-রানীকে ভারতীয় উপমহাদেশের উদ্দেশ্যে যাত্রা করবেন বলে সাহায্য চেয়ে আবেদন করেছিলেন।প্রচুর সোনা আর মসলাপাতি এনে দেওয়ার পরিবর্তে স্পেনের শাসক কলম্বাসকে লাভের ১০ শতাংশ ও নতুন আবিষ্কৃত ভূমির গভর্নর পদ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। আমেরিকার ইন্ডিয়ান আদিবাসীরা তখন অলংকার পরত। তাতে তাঁর ধারনা হয়েছিলসেখানে নিশ্চয় অনেক সোনা পাওয়া যাবে। ১৪৯২ সালের ১২ অক্টোবর বাহামায় অবতরণ করে কলম্বাস ভেবেছিলেন তিনি ইন্ডিয়াতে এসেছেন কিন্তু ইউরোপ থেকে সোজা পথে যে আমেরিকা নামে মহাদেশ রয়েছে তখন তা ছিল ইউরোপীয়দের কাছে অজানা। কলম্বাস পুরস্কার ঘোষণা করেছিলেন, যে প্রথম জমি দেখতে পাবে সে দশ হাজার ম্যারাভেদিস পাবে, তাঁরই জাহাজের একজন নাবিক রোড্রিগো প্রথম জমি দেখেছিলেন কিন্তু কলম্বাস বলেন, না তিনিই আগে দেখেছেন, সুতরাং পুরস্কার তারই প্রাপ্য!
কলম্বাস লক্ষ করেন আরাওয়াক গোষ্ঠীর লোকজনদের কানে সোনার দুল, কলম্বাসের উদ্দেশ্যই ছিল সোনা,সুতরাং তিনি বেশ খুশি হলেন। আরাওয়াক লোকজনদের অনেককে বন্দী করে কলম্বাস সোনার উৎস সন্ধানে একে একে কিউবা, হাইতি, ডোমিনিকান রিপাবলিকে যান। এরপর হিসপানিওলায় সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করেন, যা আমেরিকায় প্রথম ইউরোপীয় ঘাঁটি। তিনি তাঁর বেশ কিছু সঙ্গী সেখানে রেখে আমেরিকা থেকে দাস নিয়ে ইউরোপে ফিরে যান। স্পেনে ফিরে কলম্বাস রাজা-রানীকে মিথ্যা তথ্য দেন। জানান, তিনি এশিয়া পৌঁছেছেন ও চীনের একটি দ্বীপে ঘাঁটি বানিয়েছেন। সেখানে অনেক সোনা ও মসলা রয়েছে, যার জন্য তার আরো বড় দল প্রয়োজন। এজন্য তিনি ১৭টি জাহাজ ও প্রায় ১,২০০ লোক নিয়ে আমেরিকার উদ্দেশ্যে রওনা দেন। এরপর থেকে শুরু হল আরাওয়াকদের ওপর অত্যাচার।
কলম্বাস আরাওয়াক গোষ্ঠীর ১৫০০ জনের থেকে ৫০০ জনকে দাস হিসেবে সঙ্গে নিয়েছিলেন, ইউরোপ ফেরার পথে তাদের মধ্যে ২০০ জন মারা যায়। হাইতির সিকাও প্রদেশে তিন মাসের মধ্যে নির্দিষ্ট পরিমাণ সোনা সংগ্রহ করে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন৷ যারা দিতে পারেনি তাদের হাত কেটে দিয়েছিলেন।তাঁর সঙ্গীদের জন্য মেয়েদের যৌনদাস হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। স্যামুয়েল এলিয়ট মরিসনের “Christopher Columbus Mariner” বইতে কলম্বাসের দস্যুপনা ও নিষ্ঠুরতার বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায়। তবে সমুদ্র সম্পর্কে তাঁর গভীর জ্ঞান ও নাবিক হিসেবে দক্ষতা ছিল।
একদিন কলম্বাস বুঝলেন, এখানে আসলে কোনও সোনা নেই। তখন তিনি আরাওয়াকদের জমি দখল করে তাদের দাসে পরিণত করলেন এবং হাজার হাজার ইন্ডিয়ানকে অমানবিক পরিশ্রম করতে বাধ্য করলেন। যার ফলে হাজার হাজার মানুষ মারা যায়। এই নির্মমতায় আরাওয়াক গোষ্ঠীর লোকরা বিষ খেয়ে গণ আত্মহত্যা করে। এইভাবে প্রায় ৫০ হাজার আদিবাসী আত্মহত্যা করে। খুন, অঙ্গহানী ও আত্মহত্যার কারণে মাত্র দুই বছরে হাইতির ২ লক্ষ ৫০ হাজারের অর্ধেক জনসংখ্যা লাশে পরিণত হয়। এই সবকিছুই ঘটে কলম্বাসের সোনার লোভে।কলম্বাস যাদেরকে রেড ইন্ডিয়ান বলে নামকরণ করেছিলেন সেই আদিবাসীদের প্রায় নিশ্চিহ্ন করার পর ইউরোপীয়রা নিজেদের বিলাসী জীবন নিশ্চিত করতে একদল সেবকের প্রয়োজন বোধ করে। তখন তারা ক্রীতদাস বানানোর নতুন বুদ্ধি বের করলো। তারা আফ্রিকা মহাদেশে গিয়ে মানুষ ধরে আনতে শুরু করে। এভাবেই আমেরিকায় কৃষ্ণাঙ্গদের আগমন। তারা স্বেচ্ছায় আমেরিকায় আসেননি, তাদেরকে জোর করে ধরে আনা হয়েছে।এসব কারণেই কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান জর্জ ফ্লয়েড হত্যার প্রতিবাদে আমেরিকা ও ইউরোপজুড়ে প্রতিবাদে উঠে এসেছে কলম্বাসের নাম। আদিবাসী মানুষের ওপর তিনি যে নিষ্ঠুরতা চালিয়েছেন তার প্রতিবাদে তাঁর মূর্তি থেকে মুণ্ড আলাদা করে ফেলা হয়।