এক নজরে

চর্যাপথের পদাবলী

By admin

May 26, 2023

দিব্যি মানুষ এই গোঁসাইজী। সকালেই চান সেরে রাধা গোবিন্দের শ্রীচরণে ফুল জল নিবেদন করে বেরিয়ে পড়ে পাহাড়তলির দু’চারটে গ্ৰাম ঘুরতে। মাঝে মাঝে দু’তিন জনের ছোট দল নিয়ে ঘোরে। সেদিনটায় একসঙ্গে বহু গাঁ ঘোরা হয়ে যায়। চাল, পয়সা, সবজি পায় অনেকটাই। মাধুকরীর জন্য উদাসী বাউলের ভরাট গলায় গেয়ে ওঠে পদাবলী কীর্তন। রামী চন্ডীদাসের আখ্যান কিম্বা মান, মাথুর, বানখন্ড, তাম্বুলখন্ড থেকে নির্বাচিত পদগুলোকে কীর্তনাঙ্গের সুরে যখন গেয়ে ওঠে তখন গাঁয়ের সব মানুষই মোহিত হয়ে শোনে। একটি ভাবের আবেশ এনে দেয় সকলের মনে।

আজ গোঁসাইজী একা। শুধু করতাল বাজিয়েই গান গেয়ে চলে। কাল্লা তাকে একা পেয়ে ঠেসনা, ঝামটা শুরু করে নিজেদের মধ্যে। নিজেদের মানে চার পাঁচজন চুনারি, তিনজন চিঁড়ে কুটুনি আর একজন শাঁখারিণী ও একজন বেলমালাওয়ালী। তবে আর একজনের কথা না বললেই নয়। যার পাথর কুঁদে শরীর গড়া, তার নাম মদন। বাবা মায়ের আদরের মদন মোহন। এ তল্লাটের গাঁ গঞ্জের লোক মদন বা মদনা বলেই ডাকে। তার বাবা মা সে বছর মথুরা, বৃন্দাবন ঘুরে এসে ঠাকুরের দয়ায় সন্তান পেয়েছিল বলে তার নাম রেখেছিল- মদনমোহন। মদনের কাজ হলো পাহাড়ের খাদান থেকে পাথর কেটে নীচে নামানো। বাছাই করা এই পাথর দিয়ে মূর্তি, থালা, বাটি, গ্লাস এমনকি ঘর গেরস্থালির সামগ্ৰী বানানো হয়। শিল্পীদের কাছে মদনের বিরাট কদর। সে নিজেও একজন জাত শিল্পী। ওর আর একটা বড়ো গুণের কথা বলতেই হয়। আড়বাঁশি বাজানোয় মদনের জুড়ি মেলা ভার। মোহন এর বাঁশিতে সুর যখন জাগে তখন কতশত মানুষ মোহাবিষ্ট হয়ে পড়ে। পাড়া ঘরের দু’চারজন মদন বানে জর্জরিত হয়ে পড়ে। এখন তার পিরীত করার সুয়াঙ্গ। এক এক সময়  পাহাড়ের ঢালে বড় বড় ঝাঁকড়া গাছের ডালে বসে বাঁশিতে মায়াবী সুর তুলে। বনে আসা মানুষজনও বেবাক হয়ে শুনতে বসে পড়ে। পাড়া ঘরের মেয়ে মরদদের কাছে মদন তখন আলোচনার বিষয়। শুধু বনে নয় হরিবাসর, কৃষ্ণযাত্রা,পালা কীর্তনের আসরেও ডাক পড়ে তার। পাহাড়বেদিয়া, ধনকোড়া, ভরতপুর, ফপসা, গিধুড়িয়া গাঁয়ের হরিবাসরেই হোক কিম্বা পালা কীর্তনের আসর, মদনের অনিবার্য ডাক আসে বাঁশিদার হিসেবে।

সবারই আগ্ৰহে সাড়া দিয়ে গোঁসাইজী খঞ্জনি বাজিয়ে গুণগুণ করে সুর ভাঁজে। মদন বাঁশিতে ফুঁ দিয়ে সুর তোলে। হঠাৎই সুর চড়িয়ে গোঁসাইজী গেয়ে ওঠে- ‘না পোড়ায়ো রাধার অঙ্গ / না ভাঁসায়ো জলে গো / মরিলে তুলিয়া রাখো /তমালেরো ডালে গো …!

রাঢ়াশ্রয়ী রাগ ও সুরে পরপর গেয়ে চলেছে গোঁসাইজী। মদনের বংশী ধ্বনি মাতাল করে তুলেছে ‌বন, পাহাড় আর গ্ৰাম জনপদকে। চৈতি হাওয়ায় মেতে উঠেছে গোটা পাহাড়তলী। যেমনি গান তেমনি বাঁশির সুর যেন গোটা গায়ে মেখে নিচ্ছে পাহাড় শুশুনিয়া। যে যেখানে যত কাজেই ব্যাস্ত থাক তাদের দু’দন্ড থমকে যেতে হয়। একদিন এমনই এক খরতাপের দুপুরে গোঁসাইজীর দল সম্মিলিত গলায় গেয়ে উঠেছিল- ‘সত্য পথে কেউ নয় রাজি / সবই দেখি তা না..না..না / জাত গেল জাত গেল বলে / এ কি আজব কারখানা …!’ লালন সাঁই-এর এই গান শুনে ফপসা গাঁয়ের প্রবীন বৈষ্ণব হরিচরণ দাসের সে কি কান্না! দু’চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে চলেছে তার। নানা বয়সের দেহাতি মেয়ে মরদ, যোয়ান ছেলে একমনে শুনছে তাদের গান। আবেগের বশে কিষ্ট দাস বলেই দিল- ‘গোঁসাই বাবাজী কি গাইলে গো! বন পাহাড়ের বাতাস বওয়া বন্ধ কইরে দিলে হে! হুই দেখ, গরুগুল্যান চরা বন্ধ করেছ্যে। গাছের কত কি পাখি গুল্যান থম মাইরে বস্যে আছে ডালে। গান শেষে গোঁসাইজী নিবিষ্ট মনে বসে আছে বাঁশের মাচায়। কাছে দূরের পথিকজন যেচে কথা বলে চলেছে তার সঙ্গে। এরই মধ্যে সিরজাম গাঁয়ের হরিবাসরে আসর পাতার জন্য পাকা কথা বলে নিল আগন্তুক দের মধ্যে একজন। বায়নানামা করে যাবে একদিন আশ্রমে এসে। পরিবেশ স্বাভাবিক হতেই কাল্লা গোঁসাইজী কে বলে ওঠে ব্যাসাম বেলা গড়াহাই গেল যে গুঁসাইজী? ইবারে খর পায়ে চ্যাল ধর হে! তুমাকে ঢের ট্য পথ পাড়ত্যে হবেক। হরিচরণ আর গুরুদাসী প্রনাম সেরে গাঁয়ের পথে পা বাড়ালো আপনমনে। চিঁড়ে কুটুনি পদ্মাবতী গোঁসাইজীর আলাদা ঝোলায় দিল প্রায় সেরখানেক ঢেঁকিতে কোটা চিঁড়ে। হারু মাঝি তার ঝুড়ি থেকে একটি আস্ত মাঝারি সাইজের কুমড়ো তুলে দিল গুঁসাইজীর হাতে। কাল্লা শাড়ির খুঁট থেকে একটি পাঁচ টাকার কয়েন দিয়ে গড় করলো গুঁসাইজীকে। একে একে সবাই চলেছে আপন আপন গাঁয়ের পথে।

চর্যাপথের পদাবলীর পটচিত্রে শেষ তুলির টান দেয় ভরতপুর গাঁয়ের রাসু পটুয়া। দূর থেকে নিটোল ছবির মতো দেখা যায় পটশিল্পীদের গাঁ- ভরতপুর। মদন শুধু বসে থাকে ভ্যান গাড়ির অপেক্ষায়। পাথর নিতে আসবে মোটর ভ্যান। সব কাজ সারা হলে ঝর্নাতলায় চান সারবে সে। তারপর লড়সিং বাবার থানে মাথা ঠেকিয়ে হাঁটা দেবে আঁকাবাকা পথ ধরে গ্ৰাম শুশুনিয়ার পানে। দুপুরের খাওয়া সেরে হাজির হবে তাদের আটচালায়। এই আর এক চর্যা পথের পদাবলীর থান। রামায়ণ গান, পাঁচালি, কথকথার আসর বসে নিত্য। আবার ছেলে ছোকরা ও দু’চারজন প্রবীন বসে যাবে তাসের আড্ডায়। দু’একজন লুডু,বাঘ-ছাগল খেলায় মত্ত হয়ে থাকে। নির্জন দুপুরে শন্ শন্ করে হাওয়া বয়। চৈতি হাওয়ায় ভেসে আসে চল্লা’র বীজ, শিমুল তুলো। শিশু কিশোরের দল তাই নিয়েই মেতে থাকে সারা’টা দুপুর । গাঁয়ের মান্যিগণ্ণি মোহিত মাস্টার শিব মড়পের উঁচু দাওয়ায় দাঁড়িয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে শুশুনিয়ার প্রলম্বিত ছায়ার দিকে। ছায়া ক্রমশ প্রসারিত হয়ে ভেঙে ভেঙে মিলিয়ে যায় কমলা পুষ্করিণীর স্বচ্ছ নীল জলে । হাউসিবাইদ এর মাঠে তখন শুরু হয়েছে প্রাণঘাতী যুদ্ধ। মহারাজা চন্দ্রবর্মা গড় দখলের লক্ষ্যে মরীয়া হয়ে উঠেছেন। অন্যদিকে মহা প্রতাপশালী তেজোদীপ্ত সমুদ্র গুপ্ত আক্রমণ হেনেছেন অত্যন্ত সুকৌশলে। পিছু হটছে চন্দ্রবর্মা বাহিনী। তারপর সবশেষ! হা হুতাশ এ ভরে গেল হাউসি বাইদের প্রান্তভূমি। হাহাকার ধ্বনি মিলিয়ে যায় অস্তাচলগামী রবি রশ্মির আলোকচ্ছটায়।

বেলা গড়িয়ে যায় আগামীর প্রতিশ্রুতিতে। যমুনা, কালিন্দী ও কদম তলা ছেড়ে ফিরতে হবে যে যার ঘরে। মদনের পাথর ভ্যান এসে গেছে। গোঁসাইজী লম্বা লম্বা পায়ে ফিরে গেছেন রাধা গোবিন্দ আশ্রমে। আনন্দময়ী দাসী তার জন্য পথ চেয়ে বসে থাকবে। গণা বাগাল ফিরবে গরুর পাল নিয়ে। রাঙাধূলায় ভরে উঠবে পদাবলীর চর্যা পথ।