এক নজরে

ভ্রমর কইয়ো…

By admin

December 04, 2022

পাঁচ

বনজ ভ্রমর ওড়ে ঋতুধর্ম মেনে। কুঁড়ি খুলে একটি-দু’টি পাপড়ির আদরে এক সময় পরিপূর্ণ ভ্রমর হয়ে ওঠে নিজেরই অগোচরে। বসন্তের বাতাস সেই বার্তা পতঙ্গকুলে। কার পাত্রে কত মউ জমা থাকে। কোন কুল কতটা সোহাগ প্রত্যাশী, সে খবরের কারবারি ওরাই। বসন্ত সমীরণে কোনও এক অজানা গাঁয়ের ভ্রমর নামে ফুটন্ত কুসুমটির দেহ-মনে-প্রাণে এক প্রদাহ দেখা দেয়। একদিন এক পাহাড়ের নির্জন ধরনাধারায় নাইতে নেমে সে নিজেকে আবিষ্কার করে বসে। শরীরের সকল আবরণ মুক্ত করে জলের আরশিতে মুগ্ধ হয়ে দেখে অনিন্দ্যসুন্দর ভাস্কর্য। কালবোশেখি মেঘের মতো তার কেশরাশি। মরাল গ্রীবা, ভরাট দু’টি কাঁধ, সদ প্রস্ফুটিত বক্ষ, চিকন কটিতট। সব মিলিয়ে এক নিখুঁত শিল্প জলের তরঙ্গে ভাঙে আর গড়ে।

সম্বিত ফিরে পেয়ে সে বলে, ‘আজকে ঘর যা ভ্রমর। অপর একদিন আদর করব।” কার্তিক মাস। বিকেল বিকেলই আলো ঢেকেছে আঁধারে। বাতাসে আলতো শীতের পরশ। তখনই ভ্রমরের কথা মনে আসে। কোনও এক কবি কোনও এক বসন্তে টেনে চোখ সেরেছিলেন দেবী সরস্বতীকে। কোনও এক কবি ঘরের সব আলো নিভিয়ে একান্তে অভিমান করেছিলেন কৃষ্ণের সঙ্গে। আর এই সে ভ্রমরকে সে কালী ভেবে তার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে  গ্রামের কোনও এক শিল্পী। তার বেলা যত দোষ? দোষ তো বটেই। প্রেমের কালীকে নিয়ে সে একেবারে আতসবাজি ফাটিয়ে, গলা পর্যন্ত তরল ঢেলে উৎসব করতে পারেনি। উল্টে তার নগ্ন রূপের সৌন্দর্যকে ভয় পেয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিল। ঠিক যেমন ভয় পেয়েছিল কৃষ্ণনগরের বেহারারা। তারাও তো কালীর মধে্য প্রেমিকাকে খুঁজে নিয়ে কাঁধে তুলে চলছিল ভাসানে। তারা ঠিকই করে রেখেছিল আর যাই হোক হল পড়তে দেবে না। দুই পাড়ার কালী মুখোমুখি হতেই …. দশনার্থীদের কাছে ‘ঠাকুর’ কাঁধে বেহারাদের সেই দৌড়টাই ছিল উপভোগ্য।

কিন্তু ওটা কী? প্রতিমা চলে যেতেই দেখা দেখা গেল রাস্তায় পড়ে এক রক্তাক্ত যুবক। পেটে বিঁধে ধারালো ছুরি। রাস্তার রঙ কালচে লাল। পরদিন পথ চলতি স্বাভাবিক-সুস্থ জীবন বলল, “ঠাকুর ভাসানের ঐতিহ্যের মতোই এই রক্ত ঝরার ঘটনা।” সে সব কথা ভ্রমরের প্রেমিক। ঠিক করে ফেলে কালীতেই ভজনা, কালীতেই সাধনা। কালীতেই চুম্বন, কালীতেই শীৎকার আবার সেই কালীতেই  শিল্প। ভ্রমরই তার কাছে কালীদর্শন। কালো? সে যতই কালো হোক…। কালী গড়ার  কাজে হাত দেয় সে। মুখের ছাঁচটি ভ্রমরের জন্য রেখে শরীরের কাঠামোটি তুলে নেয় ছেনি বাটালির প্রয়োগে। কালী শরীরের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ খাঁজ, ভাঁজ, বাঁক, রেখা, বৈচিত্র শানিত নরুনে চিরে চিরে ফুটিয়ে ফুটিয়ে তোলে। তার মরাল গ্রীবাটি মসৃণভাবে ফুটে উঠল। যন্ত্রের প্রয়োগে কাঁধ দু’টি গড়ে উঠল। তার হাত বুকের উপত্যকায় নেমে আসে। বাটালির শানিত কলায় জীবন্ত হয় বুকের ডৌল। নাভিমূল, চিক্বন কটিদেশ। চতুর্দশীর রাত। ভ্রমরদের হাতে তুলে দেবে আর এক ভ্রমরকে। আয়োজন সারা। ভ্রমরও যেন নিজেকে দেখবে অন্য রূপে। বা হয়তো একেবারেই নিজের রূপে।

খিলখিলিয়ে হেসে উঠল ভ্রমর। বলল, “কিছুই কুঁদতে পারলি না রে। কালী যে সে জিনিস নয়। সেই একমাত্র দেবী যার অলঙ্কার তার নিজের রূপ, আর অন্ধকার রং। সেই একমাত্র দেবী যার যাতায়াত সমাজের সবচেয়ে উপেক্ষিত, অবহেলিত সমাজেও। রাজা ভজে, চোরও পূজে।  তিনি কোনও সমঝোতায় নেই। দেবতাদের মধ্যে চরম আধুনিক ও অকুতোভয় বলেই রাতবিরেতে তাঁর দেখা মেলে। তিনি উপাসকের, তিনি পাষাণ্ডের। চরম সাম্যবাদী। আমি তো আপনার চোখে ভ্রমর।  কালী হলাম কই। কুঁদতে পারলি না ঠিকঠাক। তুই একটা ডাইন গড়েছিস। এর তেজ গেল কুথায়। কাল গড়ব ত্যাখন বলবি।” ভ্রমরের প্রেমিক সাফল্যের হাসি হাসে।