বীরভূমের সদর শহর সিউড়ি থেকে আমজোড়া যাওয়ার পথে ৯ কিমি দূরে ভান্ডীরবন গ্রাম। সিউড়ি থেকে আমজোড়া যাওয়ার পথ শহূরে পরিবেশের মধ্য দিয়ে শুরু হলেও কিছু দূর যাওয়ার পরেই গ্রাম্য প্রকৃতি। সেই পথ দিয়ে চলতে চলতে পড়বে বড়চাতুরী স্বাস্থকেন্দ্র, ওই স্বাস্থকেন্দ্র পেরিয়ে ডান দিকের ছায়া ঘেরা গ্রামীন রাস্তা দিয়ে কিছু দূর গেলেই পৌঁছানো যায় ভান্ডীরবন গ্রামে। প্রসঙ্গত, সিউড়ি-আমজোড়া বাদশাহী সড়ক ধরে ছ’মাইল উত্তর-পশ্চিমে এগোলেই ময়ূরাক্ষী নদীর তীরে শৈব, শাক্ত ও বৈষ্ণবের মিলনক্ষেত্র। সেই ক্ষেত্রের পূর্বদিকে অধিষ্ঠিতা রাজা বীরসিংহের আরাধ্যা ঈশ্বরী দেবী মগধেশ্বরী কালী, পশ্চিমে ঋগ্বেদের খ্যাতকৃত্য ঋষি বিভাণ্ডক প্রতিষ্ঠিত দেবাদিদেব ভাণ্ডীশ্বর শিব আর তার মাঝে এলাকার রাজাধিরাজ গোপাল জিউয়ের রাতুল চরণপদ্ম।
কথিত, এখানে ঘোর জঙ্গলের মধ্যে মহর্ষি বিভাণ্ডক আশ্রম স্থাপন করে এই ভাণ্ডীশ্বর শিবের প্রতিষ্ঠা করেন। বহু আগে এই জায়গা ঘন জঙ্গলে ভর্তি ছিল। এই জঙ্গলেই কঠোর তপস্যায় সিদ্ধিলাভ করেন বিভান্ডকমুনি। আর তাঁর নাম অনুসারেই এই বনাঞ্চলের নাম হয় বিভাণ্ডক বন। কালক্রমে পরিবর্তিত হয়ে ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রাধিপতির নাম যুক্ত হয়ে নাম হয় ভাণ্ডীরবন। ভাণ্ডীশ্বর শিব পশ্চিমলিঙ্গ শিব, যা সাধারণত বিরল। আসলে ভাণ্ডীশ্বর কোনো শিলাখণ্ড নন্, ভূগর্ভে যে বিশাল আয়তনের কূর্মপৃষ্ঠাকৃতি শিলাস্তর লুকিয়ে রয়েছে, এ হলো তার সামান্যমাত্র উপরিভাগ। তাই গৌরীপাটের নিচে যে অংশটুকু দেখা যায়, তাতে কোনো শিল্পীর ছোঁয়া বা কৃত্রিমতা কোনোটাই নেই— যা আছে, তার সবটাই প্রাকৃতিক। এখানে বসেই মহর্ষি বিভাণ্ডক রচনা করেছিলেন ঋগ্বেদের ১০২৪ সংখ্যক শ্লোক।
বিভাণ্ডক মুনির পর এই ভাণ্ডীশ্বর শিবের সেবা-পুজোর আয়োজন ও উপকরণে দৈন্যদশা দেখা দেয়। তখন স্থানীয় বীরপুর গ্রামের অধিবাসী একজন শিবের পাণ্ডা এসে নিয়ম রক্ষা করে পুজো করে যেতেন। এরপরের ঘটনা মুর্শিদাবাদের নবাব আলীবর্দী খাঁর সময়ের। রামনাথ ভাদুরী ছিলেন তার উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী। ঠিক সেই সময় এই ভান্ডীরবন অঞ্চলের অধিপতি ছিলেন আসদজ্জামান খাঁ। তার প্রচুর খাজনা দেওয়া বাকী থাকায় আলিবর্দী খাঁ রামনাথ ভাদুরীকে এখানকার খাজনা আদায়ের জন্য পাঠান। রামনাথবাবু এখানে আসার পর থেকেই নানান অলৌকিক ঘটনার সাক্ষী হতে থাকেন। শেষ পর্যন্ত শিব মাহাত্মে মুগ্ধ হয়ে এখানকার বহু খাজনা মুকুব করিয়ে দেন। আসদজ্জামানও খুশি হয়ে তাকে ভান্ডীরবন, রাইপুর, বীরসিংহপুর ও আড়াইপুর মৌজা দান করেন। কিন্তু রামনাথবাবু এই জমি নিজে না নিয়ে সেগুলি ভান্ডেশ্বর শিব, গোপালদেব, বীরসিংহপুরের কালীমাতার পুজো, নিত্যসেবা ও ভোগের জন্য উৎসর্গ করেন। শুধু তাই নয় তিনি মুর্শিদাবাদ থেকে কারিগড় আনিয়ে ভান্ডীরবনে গোপাল ও শিবের মন্দির নির্মান করান।
মূল মন্দিরের সামনে একটি প্রাচীন গাছ। মন্দিরের বাইরে রথ রাখা আছে। মূল প্রবেশদ্বারের উপরে প্রাচীন নহবতখানা। দেওয়ালের গায়ে দেব দেবী, জীব জন্তুর প্রতিকৃতি। প্রবেশদ্বার পার হতেই কারুকার্যমন্ডিত স্তম্ভের উপর রয়েছে নাটমন্দির। ডানধারেই সরু চলার পথ দিয়ে কয়েকটা সিঁড়ি বেয়ে উঠলে মূল মন্দিরের বারান্দায় পৌঁছানো যায়। গোপালমূর্তির বিশেষত্ব এই যে ওঁর পাশে কোনো রাধার মূর্তি নেই। চওড়া বারান্দা প্রদক্ষিন করলেই বাদিকে ভোগঘর। সামনে সোনার মতো চকচকে ভোগের বাসনপত্র রাখা আছে। গাছপালায় ভর্তি পুরো মন্দির প্রাঙ্গণটি প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। গোপালদেবের মন্দির থেকেই পিছনের শিবমন্দিরের চূড়া দেখতে পাওয়া যায়।
গোপালদেবের মন্দির থেকে ৩০ মিটার দূরে প্রাচীন এই শিব মন্দির। উচ্চতায় প্রায় ১৫০ ফুট। নির্মানকাল ১৭৫৪ খ্রীষ্টাব্দের আসে পাশে বলে জানা যায়। প্রবেশপথেই এক অতিবৃদ্ধ বৃক্ষ ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে। মূলমন্দিরে বেশ কয়েকটা সিঁড়ি বেয়ে মহাদেবের কাছে যাওয়ার দরজায় পৌঁছানো যায়। এখান থেকে দর্শন করা গেলেও একেবারে কাছ থেকে দর্শনের জন্য খান সাতেক সিঁড়ি ভাঙ্গতে হয়। ঠান্ডা ও আলো আঁধারে ঘেরা এই গর্ভগৃহ। মন, শরীর শিথিল হয়ে আসে এখানে। এই মহাদেব পশ্চিমলিঙ্গ। ময়ূরাক্ষীর পাড়ের এলাকাটির পরিবেশও সুন্দর। এছাড়াও ছড়িয়ে রয়েছে বেশ কিছু ছোট মন্দির।গোপাল মন্দিরের মাঠে রাস, গোষ্ঠরথের মেলা বসে। পৌষে বনভোজন আর বসন্তে দোল উৎসব উপভোগ করতে বহু মানুষ ছুটে আসেন।
কীভাবে যাবেনঃ বীরভূমের সদর শহর সিউড়ি থেকে ৯ কিমি দূরে এই মন্দির। সিউড়ি থেকে অটো বা গাড়িতে যেতে মিনিট কুড়ি লাগে। কলকাতা থেকে সরাসরি সিউড়ি আসার প্রচুর বাস আছে, হাওড়া থেকে ট্রেন আচ্ছে। রাত্রিবাস করতে চাইলে তার জন্য সিউড়িতে নানান মানের হোটেল ও লজ আছে।