এক নজরে

বাঙালী মুসলিম মেয়েদের পোশাক ও প্রসাধনী

By admin

July 17, 2025

শেষ পর্ব

সুরাইয়া সুলতানা

সুগন্ধি মোঘল রাজাদের বিলাসিতার অন্যতম উপকরণ ছিল। শোনা যায় আকবর জন্মগ্রহণ করলে আনন্দে সম্রাট হুমায়ুন তার আশপাশের মানুষদের কস্তুরি মৃগনাভির সুগন্ধি বিতরণ করেছিলেন। সেইসময় তাঁর কাছে আর দেওয়ার মতো কিছু ছিল না। তিনি যুদ্ধে হেরে আত্মগোপন করেছিলেন। এর থেকেই বোঝা যায় সুগন্ধি দ্রব্য ব্যবহার কতটা প্রভাবিত করতো সেই মধ্যযুগের আগেও। গায়ের গন্ধ সুগন্ধি দ্রব্যের সঙ্গে সংমিশ্রণে তৈরি হয় এক অন্যন্য ও একক মৌলিক ব্যক্তিত্ব। তাই সাজ পোশাকের সঙ্গে মিলিয়ে মানানসই সুগন্ধি ও অন্যান্য প্রসাধনী ব্যবহারও অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। শরীরের এই গন্ধই একজন ব্যক্তির মানসিকতার অবস্থানকে প্রকাশ করতে বা বুঝতে সাহায্য করে বৈকি।

সুফিবাদ প্রচারের প্রাককালে কিম্বা মোঘল আমল থেকেই এদেশে মুসলমানদের আচার বা সংস্কৃতির মেলবন্ধন হয়েছে ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে। অন্তরধর্ম বিয়ে সেই সময়ের সম্রাটরাই করতেন সে রাজনৈতিক কারনেই হোক বা সামাজিক কারনে। বৈবাহিক সম্পর্ক কিন্তু সমাজ জীবনে এক অন্য প্রভাব বিস্তার করে। আর সেই পরম্পরায় নানা সামাজিক সংস্কৃতি ও কৃষ্টি বা পোশাক পরিচ্ছদের মধ্যে সামঞ্জস্যপূর্ণ মেলবন্ধন বা বিনিময় হয়। যেমন মাথায় টুপি বা পাগড়ি এদেশে এসেছে বিদেশের হাত ধরে কিন্তু পরবর্তীকালে সমস্ত জাতির মধ্যে তা এখনো প্রচলিত আছে। তার ধরন বা নকশার পরিবর্তন হয়েছে হয়তো কিন্তু মূল মস্তকাবরণটি একই আছে। আর তা প্রবাহিত হয়েছে ভারতীয় সংস্কৃতিতে। বিদেশি পোশাক আশাক বা প্রসাধনী সাদরে গৃহীত হয়েছিল এদেশে সে ধারা এখনো প্রবাহমান।

বিয়ের আচার অনুষ্ঠানে বা পোশাকে বিস্তর মিল দেখা যায় বঙ্গ থেকে কাশ্মীর কিম্বা পশ্চিমঘাট থেকে পূর্বঘাট পর্যন্ত বিস্তীর্ণ ভারতে যত রাজ্য আছে। হলদি, মেহেন্দি, রঙ খেলা বা হোলি, বিয়ের অনুষ্ঠানে বর কনের শুভদৃষ্টি বা হাত মেলানোর অনুষ্ঠানে। যাকে বলে রস্ম। অনেক জায়গায় মুসলিম বিয়েতে কাপড় দিয়ে ঢেকে বর কনে দুজনকে আয়না দেখানো হয়। কোনো বড় নানি বা দিদা কিম্বা দাদি বা ঠাকুমা এটা করে থাকেন। চারচোখ এক করার শুভদৃষ্টি। এই আচার বা রসমকে চারচশমী বলে। এই চারচশমা নামের একটি আরবী অক্ষরও আছে। সেই অক্ষরের মহিমাকে মহিমান্বিত করতে এই রস্ম। আবার হিন্দু বিয়েতেও সেই শুভদৃষ্টির অনুষ্ঠানে কনে পানপাতা দিয়ে ঢেকে বর কনে সেই রসম সম্পূর্ণ করে। বিয়েতে শালিকারা বরের জুতো চুরি করে থাকে। সারা ভারতে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে এমন মজা করেই থাকে। সংস্কৃতির মেলবন্ধন এভাবেই হয়। সেই সঙ্গে দেখা যায় পোশাকের মিলও। বর কনের পোশাক সাধারণত পাঞ্জাবি, শেরওয়ানি, পাগড়ি, পাজামা, ঘাঘরা চোলি বা শাড়ী পরা সমস্ত জাতির মধ্যেই খুব সাধারণ ব্যাপার।

মুসলমান বিয়েতে আর অবাঙালী হিন্দু বিয়েতে টোপর পরার নিয়ম নেই। তারা মাথায় পাগড়ি পরে। আর কনেকে মাথায় চুলের খোপা বা নানা ডিজাইনের বেনী করে ফুল মালা দিয়ে সাজায়। বেনীতে এক লম্বা সোনা বা রুপোর গয়নাও ব্যবহার করেন অনেকে। চুলের কাঁকন বা কাঁটাও কিছুদিন আগে খুবই জনপ্রিয় ছিল। এখনো নাচের পোশাকের সঙ্গে বা বিয়েতে চুল সাজাতে ব্যবহার হয়। মেয়েদের চুল বা চুল সাজানোর প্রথা কিছুটা শৃঙ্গারের সঙ্গেও যুক্ত। ঘন কালো লম্বা চুলের বিবরণ আমরা কবি লেখকদের রচনায় পাই। আর নাকে মুক্ত দিয়ে সাজানো বড় চুড়ির মতো নথ পরে বিয়েতে। কিন্তু বাঙালি মুসলিম বিয়েতে কনে নাকে সাধারণত নাকফুল বা নাকছাবি পরে থাকে। কানে ঝুমকো। ঝুমকো সারা ভারতেই সমান জনপ্রিয়। এই ঝুমকো গুম্বুজের মতো দেখতে। এটা মোঘল আমলের নক্সার অনুকরণ। যুগে যুগে জাতিভেদে, দেশভেদে পোশাক বা গয়নার নক্সাতেও ভিন্নতা দেখা গিয়েছে। হাত অন্তর অথবা দেশ অন্তর মানুষের সংস্কৃতির মেলবন্ধনের সঙ্গে সঙ্গে তার রুপান্তর ঘটে যায় কালের স্বাভাবিক নিয়মেই। আর বর্তমানে পোশাকের ডিজাইন বা গহনাদির নক্সা ঘুরে ফিরে আসছে।

আজকের দিনে সেকেলে ডিজাইনেরও যথেষ্ট কদর আছে। ঐতিহ্যকে, শিল্পকে কদর করার মধ্যেই কিছু আসল শিক্ষা লুকানো আছে। পোশাক ডিজাইনের ব্যপারে মুসলমান কারিগরেরা মোঘল যুগে বেশ সাফল্য লাভ করেছিলো। কারখানা তৈরির মাধ্যমে পোশাকের নকশা বা ডিজাইনে দর্জিরা খুবই উন্নতি লাভ করেছিল। তারা মেয়েদের পোশাক নিয়েও নানা ধরনের এক্সপেরিমেন্ট করতো। আর সালোয়ার কামিজে নতুন রুপ দিয়েছিল সারারা বা গারারা। কামিজে, ওড়না বা দোপাট্টাতে, শাড়ি বা ব্লাউজে সোনা রুপোর তৈরি সুতো বা পুথি দিয়ে নকশা করে ব্যবহার করতো। সুতোর কাজ তো ছিলই। এখনো ভারতের নানা প্রদেশে নানা ধরনের সুতোর কাজের নকশা দেখা যায়। প্রত্যেকটাই খুব স্বতন্ত্র্। যেমন কাশ্মীরী সেলাই, গুজরাটি সেলাই, লক্ষনৌ চিকনকারি, বাংলার কাঁথা স্টিচ। এসবই পোশাকে নকশা বানিয়ে ব্যবহার করার প্রচলন ছিল। এখনো আছে। এই নিয়ে আমাদের দেশে নানা টেকনলোজিক্যাল ইন্সটিটিউটও তৈরি হয়েছে সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে। এগুলি এখন পড়াশুনা বা নিয়মিত চর্চার অঙ্গ আন্তর্জাতিক বাজারে টিকে থাকার জন্য। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে ভারতবর্ষে এসব নিয়ে জনসচেতনতা এখনো বহুলাংশে পৌঁছাতে পারেনি। যতটা বস্ত্রশিল্পে এগিয়ে থাকার কথা ছিল তা হয়নি। যে হারে এই শিল্প অত্যাধুনিক কুটিরশিল্প হিসেবে খ্যাতি অর্জন করা উচিত ছিল তা হয়ে ওঠেনি। বর্তমানে প্রসাশনিক উদ্যোগ বা সরকারি এজেন্ডার মধ্যে এসব অন্তর্ভুক্ত না হলে বা উৎসাহ না দিলে মানুষ দিশাহীন ভাবে এগোতে থাকবে। এটাই স্বাভাবিক।

বর্তমানে ভারতীয় তথা বঙালি মুসলমান মেয়েরা পোশাক ব্যবহারের ক্ষেত্রে খুবই উদার মনোভাব পোষণ করে। একাধারে তারা কেউ কেউ যেমন নিত্য নতুন ডিজাইনের হিজাব বা বোরখা, নানা ডিজাইনের ওড়না ফ্যাশন হিসেবে নিতে জানে তেমনই বিশ্ববাসী হিসেবে নানা দেশ বা রাজ্যের পোশাক পরতেও তারা সমান আগ্রহী। এই হিজাব বা বোরখা এসেছিল আরব দেশের আলখাল্লার হাত ধরে। আরবে নারী পুরুষ নির্বিশেষে মরুভূমির গরম হাওয়া থেকে বাঁচতে আলখাল্লা জাতীয় পোশাক ব্যবহার করে। এদেশের কোনায় কোনায় যখন সেই আলখাল্লা বোরখা হিসেবে পৌঁছালো তখন কনভার্টেড মুসলিম ছেলেরা মেয়েদের পর্দা প্রথার সঙ্গে সেই বোরখা জুড়ে দিল। ভারতীয় ছেলেদের জন্য আর আলখাল্লা রুপান্তরিত হল না। এই হল ধর্ম ব্যবসায়ীদের এক আজব খেলা কিম্বা পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার পরিচয়। ধর্মে আছে শালীনতা বজায় রাখার কথা। নিশ্চয় তার ভালো দিক আছে। তার মানে এই নয় আপাদমস্তক মোটা কাপড়ে নিজেকে ঢেকে নিয়ে অসুস্থ বোধ করা!