এক নজরে

বাঙালির মহালয়ার ভোরে  

By admin

September 24, 2022

প্রেমাঙ্কুর আতর্থী একদিন বলেন, যা যা অনুষ্ঠান চলছে, তার পাশাপাশি কিছু অভিনবত্ব আনা দরকার। লেখালেখির জন্য বাণী রয়েছে, রাই সুর দিক, বীরেন শ্লোক আওড়াক্‌…ভোরবেলায় একটা অনুষ্ঠান লাগিয়ে দাও, লোকজন ভালই নেবে। কথাটা নৃপেন মজুমদারের মনে ধরল। বাণীকুমার ভাবতে বসে গেলেন। একমাস বাদে দুর্গাপুজো। বীরেন ভদ্র বললেন, যদি পুজোকে কেন্দ্র করেই কিছু করা হয় তাতে চণ্ডীপাঠ অবশ্যই থাকবে।সেই শুরু।১৯৩২ সালে মহাষষ্ঠীর সকালে ‘প্রত্যুষ প্রোগ্রাম’ শিরোনামে এই অনুষ্ঠান প্রথম সম্প্রচারিত হয়। পরের বছর হয় ‘প্রভাতী অনুষ্ঠান’ নামে, ১৯৩৬-এ ‘মহিষাসুর বধ’, ১৯৩৭ সালে শিরোনাম হয় ‘মহিষাসুরমর্দিনী’। তবে প্রথম দু’বছর অর্থাৎ ১৯৩২ ও ১৯৩৩ সালে অনুষ্ঠানটি ষষ্ঠীর ভোরে সম্প্রচারিত হয়ে, ১৯৩৪ সাল থেকে মহালয়া-র ভোরে সম্প্রচারিত হতে থাকে। মাঝে কয়েকবার আবার অদলবদল হলেও অবশেষে মহালয়ার ভোরেই সম্প্রচার স্থায়ী হয়।

প্রথম কয়েক বছর অনুষ্ঠানটির সঙ্গীত পরিচালনায় পঙ্কজ মল্লিকের সঙ্গে ছিলেন রাইচাঁদ বড়াল। এছাড়াও ছিলেন পণ্ডিত হরিশ্চন্দ্র বালী, সাগির খাঁ প্রমুখ। অধিকাংশ গানে পঙ্কজবাবু সুর করলেও ‘বিমানে বিমানে আলোকের গানে…’ সুর করেছিলেন পণ্ডিত হরিশ্চন্দ্র বালী, ‘শান্তি দিলে ভরি…’ উস্তাদ সাগির খাঁ এবং ‘নিখিল আজি সকল ভোলে …’ গানটিতে রাইচাঁদ বড়াল সুর করেন। প্রসঙ্গত, ‘নিখিল আজি…’ গানটি বহুকাল বাদ গিয়েছে। কেবল ওই গানটি নয় আরও অনেক গান পরে বাদ দেওয়া হয়েছে। সংস্কৃত-স্তোত্রও অনেক কমানো হয়েছে। প্রথম দিকে এক ঘণ্টার হিসেবে অনুষ্ঠান শুরু হলেও কোনও কোনও বছর দু’ঘণ্টা পর্যন্ত ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ চলেছিল। পরে দেড় ঘণ্টায় স্থায়ী হয়। ১৯৭২ সালে স্থায়ী ভাবে রেকর্ড হওয়ার আগে পর্যন্ত এই অনুষ্ঠানের বহু পরিবর্তন ঘটে। এমনকি ১৯৪৪ ও ১৯৪৫ বছর দু’টিতে সঙ্গীত পরিচালক পঙ্কজ মল্লিকের সঙ্গে বেতার-কর্তৃপক্ষের মনোমালিন্য হওয়ায় তিনি অনুপস্থিতছিলেন। ১৯৪৫ সালে সঙ্গীত পরিচালনার কাজ সামলেছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। তিনি অবশ্য গানের সুর এক রেখেছিলেন।

সম্পূর্ণ নতুন একটি অনুষ্ঠান হয়১৯৪৫ সালে। সেটির যৌথ সঙ্গীতপরিচালক ছিলেন বিজনবালা ঘোষদস্তিদার ও শচীন দাশ মতিলাল। কিন্তু সেই অনুষ্ঠান একেবারেই জনপ্রিয় হয়নি। ফের ১৯৪৬ সালে‘মহিষাসুরমর্দিনী’ হয় পঙ্কজকুমার মল্লিকের সঙ্গীত পরিচালনায়।তবে সে বছর কলকাতায় ভয়াবহ দাঙ্গার কারণে লাইভ সম্পচার হয়না।বেতার কতৃপক্ষ অত রাতে শিল্পীদের নিয়ে আসার ঝুঁকি নেননি৷ ওই একটি বছর বাদ দিলে লাইভ সম্পচার একটানা চলে ১৯৬২ অবধি। এর পর রেকর্ডিং করা অনুষ্ঠান শোনানো হলেও, রেকর্ডারের অনুন্নত মানের জন্য ২-৩ বছর অন্তর নতুন করে রিহার্সাল দিয়ে রেকর্ডিং করা হত, তবে স্থায়ী রেকর্ডিং হয় ১৯৭২ সালে।

‘মহিষাসুরমর্দিনী’ স্থায়ীভাবে রেকর্ড করে রাখার আগে পর্যন্ত বহু খ্যাতনামা শিল্পীরা গান গেয়েছিলেন, আমরা তাঁদের গান শুনিনি, যেমন জগন্ময় মিত্র, রাধারানী দেবী, সাবিত্রী ঘোষ, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, পান্নালাল ভট্টাচার্য, শচীন গুন্ত, বাঁশরী লাহিড়ি, শৈলেন মুখোপাধ্যায়, কল্যাণী মজুমদার, অখিলবন্ধু ঘোষ প্রমুখ। এঁদের আগেও কৃষ্ণ ঘোষ, আভাবতী, প্রফুল্লবালা, বীণাপানি, প্রভাবতী প্রমুখ গেয়েছিলেন। ‘বেতার জগত’ পত্রিকা থেকে জানা যায়, ১৯৪০-এ গাইতেন অনিল দাস, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, শৈলদেবী, ইলা ঘোষ, সুপ্রভা ঘোষ (সরকার), কল্পনা হাজরা। তখন ‘বিমানে বিমানে আলোকের গানে…’গাইতেন শৈল দেবী, ‘বাজল তোমার আলোর বেণু…’; ১৯৪০ থেকে ১৯৫১ পর্যন্ত হেমন্ত মুখোপাধ্যায় গাইতেন ‘জাগো দুর্গা, জাগো দশপ্রহরণধারিণী…’, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া, ‘তব অচিন্ত্য …’গানটি প্রথম দিকে ছিল না; অন্তর্ভুক্ত হয় পাঁচের দশকে। ‘মহিষাসুরমর্দিনী’তে অজস্র শিল্পী বিভিন্ন সময়ে গাইলেও, কৃষ্ণচন্দ্র দে, যূথিকা রায়, শচীন দেব বর্মন, কানন দেবী, কে এল সায়গল, সুধীরলাল চক্রবর্তী, রবীন মজুমদার, মান্না দে’র মতো প্রখ্যাত শিল্পীকোনও দিনই গান করেননি।