এক নজরে

সময়ে অসময়ে

By admin

January 12, 2023

পর্ব-এক

ফাংশন৷ বাঙালির বারো মাসের তেরো পার্বণের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ৷ পুজো শেষ হলেই ফাংশনের রমরমা বাড়ে পাড়ায়-পাড়ায়, অলিগলিতে৷ কোথাও হোল-নাইট ফাংশনে, কোনও কোনও জায়গায় আবার ফাংশন সীমাবদ্ধ থাকে শুধুমাত্র গভীর রাত পর্যন্তই৷ তারপর শিল্পীদেরও ছুটি৷ সব গুটিয়ে কর্তারাও শেষ রাতে ক্লান্ত শরীর এলিয়ে দেন বিছানায়৷ ফাংশনের রেশ নিয়েই ঘুমের দেশে পাড়ি দেন শ্রোতারা৷ ইদানিং যদিও প্রশাসনিক কড়াকড়িতে ফাংশনের শব্দ-দানবের  রমরমা অনেকটাই আয়ত্তের মধ্যে এসেছে৷ তবে এই ফাংশনের মধ্যে লুকিয়ে থাকে নানা মজার ও আনন্দের মুহূর্তও৷ তাই ক্লাবের মাঠে কিংবা পাড়ার মোড়ে রাত্রিকালীন ফাংশনের আনন্দ আজও অমলিন৷

মা দুগ্গা তাঁর সন্তানদের নিয়ে যেই না বাপের ঘর ছেড়ে কৈলাসের পথে পা বাড়ান, ফি বছর সেই সময় থেকেই শুরু হয় যায় ব্যস্ততা৷ বিভিন্ন পুজো কমিটির কর্তারা ফাংশনের আয়োজনে তখন ব্যস্ত হয়ে পড়েন৷ যে পুজো কমিটির যেমন বাজেট, সেই পুজো কমিটি তেমন জাঁকজমকপূর্ণ ফাংশনের আয়োজন করে৷ কেউ নামীদামি শিল্পীদের এনে মাঠ ভরিয়ে দেয়৷ আবার কারও পক্ষে অর্থের অভাবে তা সম্ভব হয় না৷ সেখানে আবার কদর পান ‘কণ্ঠী’ শিল্পীরা৷ আশা, লতা,মান্না, রফি, কিশোর-কণ্ঠীদের জমানা দিনের পর দিন ধরে চলে আসছে৷ আর কয়েকজন উঠতি গায়ক-গায়িকা থাকেন, যাঁরা গলার জাদুতে উদ্বেল করেন জনতাকে৷ আর দুধের স্বাদ ঘোলে মিটিয়েই উদ্বেলিত হন শ্রোতারা৷ অনেক সময় পাড়ার মধ্যেই পাওয়া যেত এমন ‘কণ্ঠী’দের৷ তখন বিনা পারিশ্রমিকে অনুষ্ঠানও সেরে ফেলা যেত৷ যেমন, আমাদের পাড়াতেই ছিলেন একজন ‘মান্না-কণ্ঠী’৷ তিনি আমাদের পাড়ায় থাকতেন না৷ তবে পাড়ারই মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন৷ ভাল চাকুরে৷ শখের গায়ক৷ তবে মান্না দে ছাড়া অন্য কারও গান তো করেনই না৷ এমনকী একেবারে মান্না দে-র স্টাইলে বসে সামনে হারমোনিয়াম নিয়েই গান করতে অভ্যস্ত ছিলেন৷ ফলে প্রতিবার তাঁর দাম পাড়ার পুজো কমিটির কাছে একইরকম থাকত৷ বিনি-পয়সার এমন গায়ককে আর ছাড়তে চায় বলুন! তাই ফি বছর ‘জামাইবাবু জিন্দাবাদ’

রবীন্দ্রজয়ন্তীতে ঘেমে নেয়ে আমাদের গলির যে ফাংশনটা, সেই স্টেজটা হত আমাদের বাড়ির সামনে। ডেকোরেটর কাকু স্টেজ বেঁধে দিয়ে যাওয়ার পর কাকু-পিসিরা সুন্দর করে সাজাত। কাগজে রংতুলি দিয়ে লেখা হত রবীন্দ্রজয়ন্তী। চেয়ারে ছবি রেখে ধূপ, মালা। জুঁই ফুলের গন্ধে ম ম করত চারদিক। ভাড়া করা লাইট আসত। রঙিন কাগজ পাল্টে পাল্টে নাচ আর নাটকের সময় আলো ফেলা দেখতে আমার দারুন লাগতো। ২৫ বৈশাখ সকাল থেকে সাজ সাজ রব পরে যেত বাড়িতে। সেদিন হিন্দি গান গাইলে পাপ হয় জানতাম। বাবা রেডিও চালাত। রবি ঠাকুরের ছবিতে মালা দিয়ে প্রণাম করার সময় আমি প্রতি বার বলতাম, এ সপ্তায় তোমার জন্মদিন, পরের সপ্তাহে আমার। তখন ওটা বলার সময় বিশ্বাস করতাম উনি বুঝি শুনছেন, এখন মনে মনে হাসি

আবার ফাংশন ঘিরে গড়ে ওঠে নতুন জীবনও৷ প্রেম-পরিণয়ের ঘটনাও বিরল নয়৷ এভাবে এক পাড়ায় বারবার ফাংশন করতে এসে সেখানকার একটি মেয়ের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হওয়ার বিষয়টিও বিরল নয়৷ এমন বহু ঘটনা আমি-আপনি হয়তো কখনও দেখেছি৷ বা কারও কাছ থেকে শুনেছি৷ তবে এ প্রসঙ্গে একটা মজার গল্প উল্লেখ করতেই হয়৷ একটি পাড়ায় বিজয়া সম্মিলনীর ফাংশন হবে৷ শ্রোতারা হাজির হতে শুরু করেছে৷ মঞ্চের পিছনের একটি বাড়িতে শিল্পীদের বসার জায়গা করা হয়েছিল৷ হঠাৎ সেখানে দেখা গেল পাড়ার একটি ছেলে জানালা দিয়ে উঁকি দিচ্ছে৷ ভিতরে কাউকে ডাকার চেষ্টাও করছে৷ বিষয়টি নজরে আসে কিছু কর্মকর্তার৷ তখন ওই ছেলেটি ধমক দিয়ে সেখান থেকে বিদায় করে দিলেও পরে জানা যায়, ফাংশানে উঠতি এক গায়িকার সঙ্গে প্রেম চলছিল ওই যুবকের৷ তাই দেখা করতেই সেদিন জানালা দিয়ে উঁকি দেওয়ার ‘দুঃসাহস’ দেখিয়েছিলেন তিনি৷

উল্টোদিকে ফাংশনে শ্রোতাদের কীর্তিও কম থাকে না৷ কেউ কেউ বসার জায়গা নিয়ে এতটাই খুঁতখুঁত করেন যে, তা নিয়ে ঝগড়া করতেও পিছপা হন না৷ কারও আবার গান শোনার থেকে বেশি মনযোগ থাকে একে অপরের সঙ্গে গল্পগুজব করার৷ অনেকে আবার সুযোগ পেয়ে ‘বাংলা হিসাব’ বুঝে নেন৷ কেউ কেউ আবার ঘুমিয়েই পড়েন৷ আর অনুষ্ঠান শেষে হাততালি দিয়ে ‘কী ভাল, কী ভাল’ বলে বাড়ির পথ ধরেন৷কিন্ত্ত মজা সবাই করেন৷ আনন্দও সবাই পান৷ আর তাই তো বছর বছর বেঁচে থাকে আম-বাঙালির এই ‘এনটারটেনমেণ্ট শো’

চলবে