রসায়ন আর রসসাহিত্য আপাদমস্তক দুটি আলাদা বিষয়। তবে দুইয়ের মধ্যে কোনও বিরোধ নেই। কিন্তু কোনও যোগ কি আছে? না তাও নেই। তাহলে বেঙ্গল কেমিক্যাল থেকে ভুশণ্ডীর মাঠ যাওয়ার পথে কোনও বিঘ্ন ঘটলো না কেন? স্পষ্ট ভাষায় এর উত্তর মেলেনা। তাঁর বড়দার কথানুযায়ী ‘সায়েনটিফিক মেকানিক্যাল ব্রেন’, পকেটে অটোমেটিক পেনসিল আর হাতে লোহার স্ট্র্যাপ বা কাঠের ‘সোঁটা’ নিয়ে লেখাপড়া শুরু, আট বছর বয়স থেকে নিরামিষাশী, ইস্কুলের একমাত্র বাঙালি ছাত্র, রসায়ন ও পদার্থবিদ্যায় স্নাতক, রসায়ন নিয়ে স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় প্রথম, পরে আবার বিএল পড়া, বেঙ্গল কেমিক্যাল ওয়ার্কসের সর্বময় কর্তা, কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে মেয়ে ও জামাইয়ের মৃত্যু, কয়েক বছরের মধ্যেই স্ত্রী বিয়োগ, ধরা পড়লে সোজা সেলুলার জেল, তবু নির্ভয়ে অরবিন্দ ঘোষ, বারীন ঘোষের নেতৃত্বে মানিকতলা বোমা মামলার ঘটনায় বোমার ফর্মুলা এবং যাবতীয় মালমশলা সরবরাহ করা, আচার বানিয়ে বয়ামে বয়ামে সাজিয়ে রাখা, হেঁশেলের সুবিধের জন্য তরল মশলা বানিয়ে শিশি ভরে রেখে দেওয়া, বানিয়েছিলেন জিলিপির পুডিং, কুমড়োর স্যান্ডউইচ ইত্যাদি,তাঁরই গল্পেরচরিত্রেরাবলে, “হাড্ডি পিলপিলায় গিয়া”, “হল্লা দগ্ধাননে নিল্লজ্জে ঘেঁচী”, “হামার জাত রূপয়া ভি কামায় হিসাবসে পুনভি করে হিসাবসে“। আপনেদেরে রবীন্দরনাথ কি লিখছেন বৈরাগ সাধন “মুক্তি সো হমার নহি”, ‘ধা ধা ধিন তা কৎ তা গে/গিন্নী ঘা দেন কর্তাকে’ ইত্যাদি। যার বৈঠকখানা গমগম করে উঠত যদুনাথ সরকার, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো মানুষেরা হাজির হতেন। এমন বিপুল বৈচিত্রময় জীবন কাটিয়েও, তিনি যে কেন কোনও স্মৃতিকথা বা জীবনচরিত লিখলেন না, তা কি কেবলমাত্র “এখন এই বয়সে, আমি আমার বন্ধুদের কাউকেই ক্ষুণ্ণ করতে চাই না” বলেই।
‘শ্রী শ্রী সিদ্ধেশ্বরী লিমিটেড’ প্রকাশিত হওয়ার পর সবাই রীতিমতো চমকে উঠেছিল।একথা উল্লেখের দরকার ওই বয়সে অধিকাংশ লেখক-জীবনেরচূড়ান্ত পর্বে পৌঁছে যান, সে বয়সে রাজশেখর বসু বাংলা সাহিত্যে আত্মপ্রকাশ করেন। তখনকার দিনের ট্র্যাডিশন ছিল, লেখকেরা নিজের লেখার ধরণ ধারণে ধীরে ধীরে পাঠকসমাজ তৈরি করতেন, পাঠকসমাজ লেখকের রুচিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠতেন। রাজশেখরের ক্ষেত্রে সেসব কিছুই ঘটেনি, তিনি ধূমকেতুর মতো আবির্ভূত হলেন,একের পর এক গল্প প্রবাসী এবং ভারতবর্ষ পত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকলে বাংলার রসিক ও বুদ্ধিজীবী পাঠকমহলে সাড়া পড়ে যায়। ধীরে ধীরে শ্যামানন্দ ব্রহ্মচারী, গণ্ডেরিরাম বাটপাড়িয়া, নন্দবাবু, তারিণী কবিরাজ, কেদার চাটুজ্যে, লাটুবাবু, নাদু মল্লিকেরা বাঙালি জীবনের অঙ্গ হয়ে ওঠে।
শুধু কি গল্প। তাঁর জীবনের অন্যতম বড়ো কাজরামায়ণ-মহাভারতের অনুবাদ ও অভিধান রচনা। ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উৎসাহে ও অনুরোধে ‘চলন্তিকা’ অভিধানের কাজ। সে কাজে সঙ্গে পান সুরেশচন্দ্র মজুমদার ও শৈলেন্দ্রকৃষ্ণ লাহাকে। বাংলা বানানের একটা আধার তৈরি করাই তাঁরএকমাত্র লক্ষ্য ছিল। তবে সে অভিধানেপরিভাষাও জায়গা পায়। পর্বতসমান সেই কাজে মতামত নিতেতিনি পৌঁছে যান রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, প্রমথ চৌধুরী, হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতো মানুষদের কাছে। অক্লান্ত পরিশ্রম শেষে ২৬০০০ শব্দ নিয়ে প্রকাশিত হয় বাংলা ভাষার অভিধান ‘চলন্তিকা’। সেটি দেখে রবীন্দ্রনাথ মন্তব্য করতে বাধ্য হলেন, “এতদিন পর বাংলা ভাষার অভিধান পাওয়া গেল।”রাজশেখর বসুর মহাভারত অত্যন্ত মূলানুগ ও সারানুবাদ আকারে অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত কিন্তু রসোত্তীর্ণ। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসের মূল মহাভারত এক লক্ষ শ্লোকে লিখিত, তা পড়া সাধারণ মানুষের পক্ষে প্রায় অসাধ্য। তাই প্রাচীন সাহিত্যের বৃহত্তম এই গ্রন্থটিকে সংক্ষেপে দুই মলাটে নিয়ে আসেন রাজশেখর বসু। তিনি মহাভারতের সেই সব অংশকে বাদ দিয়েছেন যা সাধারণ মানুষের কাছে নীরস এবং তাত্ত্বিক। চলিতভাষা ব্যবহার করে এবং নানা জটিলতা ও দুরূহতা পরিহার করে রামায়ণ-কাহিনিকে তিনি উপন্যাসের মতো আকর্ষণীয় করে তুলেছিলেন। এত রকমের চর্চার পরও রাজশেখর বলছেন, “আসলে আমি আধা মিস্ত্রি, আধা কেরানি। অভিধান তৈরি ও পরিভাষা নিয়ে নাড়াচাড়া মিস্ত্রির কাজ। রামায়ণ মহাভারত অনুবাদ কেরানির কাজ।”